মাসিক অবস্থায় ইসলাম মতে নারীর করণীয় ও বর্জনীয় — নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে পূর্ণ গাইড
আরো পড়ুনঃ আশুরার গুরুত্ব ও মহররম মাসের তাৎপর্য – ইতিহাস, আমল ও শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
প্রতিটি নারীর জীবনের একটি অতি স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থা হলো, হায়েজ বা মাসিক। এটি কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি করা একটি জৈবিক নিয়ম।
তবে, এই সময়টিতে নারীদের শরীর যেমন বিশ্রাম চায়, তেমনিভাবে ইসলামও এর জন্য কিছু করণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণ করেছে। অনেকেই, এই বিষয়ে সচেতন না থাকায় বা অজানা থাকায় বিভ্রান্তিতে পড়েন। আবার অনেকেই ভুল রীতিনীতির শিকার হন।
মাসিক অবস্থায় ইসলাম মতে কি করা যাবে আর কি যাবে না
মাসিক/ হায়েজ কী? মাসিকের ইসলামিক সংজ্ঞা কি?
হায়েজ বা মাসিক হলো, নারীদের জন্য প্রাকৃতিক শারীরিক প্রক্রিয়া। যা সাধারণত, প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময় ধরে হয়ে থাকে। ইসলামী শরীয়তের ভাষায়, মাসিক বা হায়েজ এমন এক ধরণের রক্ত যা, প্রজনন ক্ষমতা প্রাপ্ত নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সময়কাল ধরে নির্গত হয়। এটি কোনো অসুস্থতা নয়, বরং এটি একটি স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়া।
মাসিক/ হায়েজের কোরআনের বর্ণনা কি?
পবিত্র আল কোরয়ানে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “তারা তোমাকে হায়েজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, এটা এক ধরনের অশুচি (অসুবিধা)।” (সূরা আল-বাকারা, ২:২২২)
ইসলামে হায়েজ বা মাসিক অবস্থা নারীদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে। যা, মূলত নারীর শারীরিক ও মানসিক বিশ্রামের জন্যই নির্ধারিত হয়েছে।
মাসিক অবস্থায় নামাজ ও রোজা সম্পর্কিত বিধান
মাসিক বা হায়েজ অবস্থায় নামাজ
মাসিক বা হায়েজ অবস্থায় নারীদের জন্য ফরজ নামাজ আদায় করা হারাম এবং তা আদায় না করার জন্য গুনাহ হবে না। তবে, হায়েজ শেষ হলে নামাজ পুনরায় শুরু করতে হবে। এই সময়ের কোনো নামাজ কাযা করতে হয় না।
মাসিক বা হায়েজ অবস্থায় রোজা
রমজানে হায়েজ বা মাসিক অবস্থায় রোজা রাখা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবে, পরে সেই রোজাগুলো কাযা করে নিতে হয়। হাদীস শরীফে এসেছে, “আমরা যখন হায়েজ অবস্থায় থাকতাম, আমাদের নামাজ ও রোজা করতে বলা হতো না।” (সহীহ মুসলিম)
মাসিক অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত ও মসজিদে প্রবেশ
মাসিক বা হায়েজ কোরআন তিলাওয়াত
অধিকাংশ আলেমগণ মনে করেন, হায়েজ অবস্থায় সরাসরি কুরআন শরীফ তিলাওত করা যাবে না। তবে, কিছু সংখ্যক আলেম মনে করেন, নির্দিষ্ট দোয়া বা আয়াত মুখস্থ থাকলে পড়া বা দোয়া হিসেবে পড়া জায়েজ।
আরো পড়ুনঃ সূরা বাকারার ৬ টি ফজিলত – ঘরকে শয়তান মুক্ত রাখার সেরা আমল
মাসিক বা হায়েজ মসজিদে প্রবেশ
সাধারণত হায়েজ বা মাসিক অবস্থায় নারীরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না। কেননা, এটি শরীয়তের আদব ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য।
মাসিক অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক
মাসিক বা হায়েজ অবস্থায় স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা ইসলামে হারাম। এই ব্যাপারে পবিত্র আল কোরয়ানে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন।
“তাদের (নারীদের) হায়েজ অবস্থায় দূরে থাকো এবং তারা পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটবর্তী হয়না।” (সূরা আল-বাকারা, ২:২২২)
তবে, প্রেম ও সৌহার্দ্যের অন্যান্য দিকসমূহ, যেমন হাত ধরা, কথা বলা, খাবার খাওয়ানো ইত্যাদি বৈধ।
মাসিক অবস্থায় করণীয় - দোয়া, জিকির, ইলম অর্জন
- দোয়া ও তাসবিহ পড়া- “সুবহানাল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” ইত্যাদি জিকির করা জায়েজ রয়েছে।
- ইসলামিক ইলম অর্জন- বই পড়া, লেকচার শোনা, ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ করা পূর্ণভাবে ইসলাম বৈধ করেছে।
- দুঃখ-কষ্টে দোয়া- মহান আল্লাহ পাকের কাছে নিজের অথবা অন্য কারো জন্য দোয়া করা খুবই ফজিলতপূর্ণ।
হায়েজ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতা
ইসলামে পবিত্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই, হায়েজ অবস্থায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা বিষয় মেনে চলা জরুরি। যেমন-
- নিয়মিত প্যাড পরিবর্তন করা।
- পরিষ্কার ও আরামদায়ক কাপড় পরিধান করা।
- গোপনাঙ্গ পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা।
- ব্যথা থাকলে বিশ্রাম ও হালকা ব্যায়াম করা।
হায়েজ সম্পর্কে ভুল ধারণা ও সঠিক ব্যাখ্যা
হায়েজ সম্পর্কে ভুল ধারণা
- হায়েজে থাকা নারী অভিশপ্ত!
- কিছু ঘরে প্রবেশ করা যাবে না।
- রান্নাঘরে ঢোকা যাবে না বা খাবার স্পর্শ করা যাবে না।
হায়েজ সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা:
ইসলাম কখনো নারীদের হেয় প্রতিপন্ন করে না। বরং ইসলাম হায়েজকে প্রাকৃতিক ও সম্মানজনক অবস্থান হিসেবে সম্পূর্ণভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) নিজের হাতে হায়েজ অবস্থায় তার স্ত্রীদের জন্য খাবার দিয়েছেন, কাঁধে মাথা রেখেছেন, ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন।
শেষকথা- ইসলাম নারীর সম্মানে সমৃদ্ধ
ইসলাম নারীদের সম্মানিত করেছে, তাই, তাদের প্রাকৃতিক অবস্থাগুলোকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। হায়েজ বা মাসিক কোনো কলঙ্ক নয়, বরং এটি একজন নারীর জীবনের অন্যতম গৌরবময় ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামী বিধানসমূহ নারীদের সুরক্ষা, বিশ্রাম ও আত্মিক উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত।
আমরা যদি সকলেই ইসলামি শরীয়তের আলোকে মাসিক বা হায়েজকালীন করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো মেনে চলতে পারি, তবে তা নারীদের জীবনে শান্তি, স্বাস্থ্য ও আত্মিক উন্নতির পথ আরো সুগম করবে।
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি উপকারি মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করুন এবং আরো নতুন নতুন তথ্য জানতে আমাদের পেজকে ফলো করে সঙ্গে থাকুন। আমাদের ব্লগের নাম বা ঠিকানা Tiretx
এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর (FAQ)
হায়েজের সময় কুরআন স্পর্শ করা যাবে কি?
আরো পড়ুনঃ নারীদের পর্দা- ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বাস্তবতা
হায়েজ অবস্থায় দোয়া করা যাবে কি?
হ্যাঁ, সব ধরনের দোয়া করা ইসলামে বৈধ ও অনেক ফজিলতপূর্ণ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url