সূরা বাকারার ৬ টি ফজিলত – ঘরকে শয়তান মুক্ত রাখার সেরা আমল- 6 virtues of Surah Al-Baqarah – The best practice to keep the home free from Satan
আরো পড়ুনঃ নারীদের পর্দা- ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বাস্তবতা
সূরা বাকারা হলো মহা পবিত্র কোরয়ানে কারিমের সবচেয়ে দীর্ঘতম সূরা, যা মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরাটি পবিত্র কোরয়ানের সূরা ফাতেহার পর শুরু হয়ে প্রায় আড়াই পারা জুড়ে বিস্তৃত।
এতে মোট ২৮৬টি আয়াত রয়েছে, যেখানে মুসলিম জীবনের হিদায়াত, শারীয়ত, ঈমান ও আমল সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। এটি এমন একটি সূরা যেখানে, মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য উপযোগী অসংখ্য বিধান রয়েছে।
কুরআনের এই সূরাটি কেবল ফিকহ, ইবাদত বা ইতিহাস নয়, বরং একজন মুসলিমের জন্য আত্মিক শুদ্ধি ও দুনিয়া-আখিরাতের মুক্তির পথও দেখায়। আজকে আমরা জানবো সূরা বাকারার গুরুত্ব, ফজব্ পাঠের সময়, নিয়ম ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। তাহলে চলুন দেখি-
হাদীসে সূরা বাকারার গুরুত্ব- The importance of Surah Al-Baqarah in Hadith-
হাদীস শরীফে সূরা বাকারার গুরুত্ব অসাধারণভাবে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
"তোমরা কোরয়ানের সূরা বাকারার পাঠ করো। কেননা, এতে বরকত রয়েছে এবং তা পরিত্যাগ করাও আফসোসজনক, আর জাদুকররা তা মোকাবেলা করতে পারে না।" (সহীহ মুসলিম: ৮০৪)
অন্য এক হাদীসে রাসূল পাক (সা.) বলেন, "যে ঘরে সূরা বাকারা তিলাওয়াত করা হয়, সে ঘরে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না।" (সুনান তিরমিযী: ২৮৭৭)
উপরের হাদীস থেকে স্পষ্টবুঝা যায় যে, এই সূরা কেবলমাত্র পাঠের জন্য নয় বরং জীবনে বাস্তব প্রয়োগে ক্ষেত্রেও অমূল্য সম্পদ।
সূরা বাকারা পাঠের সময় ও নিয়ম- Time and rules for reciting Surah Al-Baqarah
সূরা বাকারা যেহেতু অনেক দীর্ঘতম একটি সূরা, তাই অনেকের পক্ষেই একসাথে পুরোটা পড়া সম্ভব হয় না। তবে, এটি নিয়মিতভাবে খণ্ড খণ্ড আকারে পড়া যেতে পারে। সূরা বাকারা পাঠের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময় ও নিয়ম, নিম্নরূপ-
- ফজরের পর অথবা রাতের নফল ইবাদতের সময় পড়া উত্তম।
- তিলাওয়াতের সময় ধীরস্থিরভাবে বুঝে বুঝে পড়া উচিত।
- চাইলে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে বা অডিও শুনেও পাঠ করা যেতে পারে।
বিশেষ করে সূরাটির শেষ তিন আয়াত ঘুমানোর আগে পাঠ করা অত্যন্ত জিলতপূর্ণ।
সুরা বাকারার ৬টি ফজিলত- 6 virtues of Surah Al-Baqarah
*** হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের ঘরকে কখনো কবরখানা বানাবে না। নিশ্চয় শয়তান ওই ঘর থেকে পলায়ন করে, যে ঘরে সুরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয়। (মুসলিম ৭৮০ জামে তিরমিজি হাদিস ২৮৮০)
*** হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন জিবরাঈল (আ.) হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসা ছিলেন, তখন তিনি ওপরের থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। ফলে তিনি মাথা উঠালেন এবং বললেন, এটা আসমানের একটি দরজা, যা আজকে খোলা হয়েছে।
এরআগে কখনও খোলা হয়নি। এরপর সেখান থেকে একজন ফেরেশতা অবতরণ করলেন, অতঃপর বললেন, এই ফেরেশতা আজকের আগে আর কখনও জমিনে অবতরণ করেনি। ফেরেশতা সালাম দিয়ে বললেন, হে নবী (সাঃ) দুটি নূরের সু-সংবাদ গ্রহণ করুন।
যা, আপনার আগে কোনো নবীকে দেয়া হয়নি। একটি হলো ফাতেহাতুল কিতাব, অপরটি সুরা বাকারার শেষ আয়াত। সহি মুসলিম ৮০৬ নাসাঈ ২/১৩৮
*** হজরত আবু উমামা বাহেলি (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, তোমরা কোরআন পড়ো। কেননা, তা কেয়ামতের দিন তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশকারী হবে। বিশেষ করে, তোমরা এই দুটি নূরানী সুরা, বাকারা ও আল ইমরান পড়ো।
কেননা এগুলো কেয়ামতে তার পাঠকারীকে এভাবে ছায়া দেবে, এগুলো যেন দুটি মেঘ খণ্ড অথবা শামিয়ানা বা পাখির ঝাঁক। এগুলো তার পাঠকদের পক্ষ থেকে (আজাব) প্রতিরোধ করবে।
তোমরা সুরা বাকারা তেলাওয়াত করো, কেননা এটা অর্জন করা খুবই বরকতের বিষয়, আর বর্জন করা অত্যন্ত আক্ষেপ ও অনুতাপের ব্যাপার। আর অলস লোকেরা এটা করতে পারে না। (সহি মুসলিম হাদিস ৮০৪)
*** হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রতিটি জিনিসের একটি শীর্ষচূড়া থাকে। আর কোরআনের শীর্ষচূড়া হলো সুরা বাকারা। এতে এমন একটি আয়াত আছে, যা কোরআনের সব আয়াতের সরদার। তা হলো আয়াতুল কুরসি। (-জামে তিরমিজি হাদিস ২৮৮১)
*** হজরত আবুজর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারাকে এমন দুই আয়াতের মাধ্যমে শেষ করেছেন, যা আমাকে তাঁর আরশের নিচের ভাণ্ডার থেকে দান করা হয়েছে। সুতরাং নিজেরা তা শিখো এবং তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের শেখাও, কেননা এই আয়াতগুলো হলো দোয়া-দুরুদ ও কোরআন। (-মুসতাদরাকে হাকেম ২/৩১৫)
আরো পড়ুনঃ ৫ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব ও উপকারিতা – নামাজ কেন জীবন বদলায় জানুন
*** হজরত নুমান ইবনে বশীর (রা.) থেকে বর্ণিত নবীজি (সাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা জমিন ও আসমান সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে একটি কিতাব লিপিবদ্ধ করেছেন। তার থেকে দুটি আয়াত সুরা বাকারার মাধ্যমে শেষ করেছেন।
যে ঘরে পর পর তিন দিন সূরা বাকারা পড়া হবে না, শয়তান সেই ঘরের নিকটবর্তী হয়ে যাবে। (জামে তিরমিজি হাদিস নং-২৮৮৫ সহি ইবনে হিব্বান হাদিস নং-৭৮২)
ঘরকে শয়তান মুক্ত রাখার সেরা আমল- The best practice to keep the house free from Satan
নিজেদের ঘর-বাড়িকে বদ জিন ও শয়তানের হাত থেকে মুক্ত রাখতে নিচের ৭টি আমল করা খুবই জরুরি। যেসব আমল ঘর বাড়িকে বদজিন ও শয়তান মুক্ত রাখবে, তাহলো-
*** বাড়িতে ইসলামি পরিবেশ চালু রাখার চেষ্টা করা। গান-বাজনা থেকে বাড়িকে পবিত্র রাখা। বিশেষ করে ঘরে যেন কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য বা ছবি টাঙানো না থাকে- এর প্রতি খেয়াল রাখা।
কারণ নবিজি বলেছেন, যে ঘরে কুকুর বা জীবজন্তুর ছবি থাকে, সেখানে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (বুখারি ৫৬১০)
*** নফল ও সুন্নত নামাজ সম্ভব হলে ঘরে পড়া। মাঝে মধ্যে বসতঘর ছাড়াও যদি আরও ঘর থাকে তবে, বাড়ির সেসব ঘরেও নফল-তাহাজ্জুদ পড়া। স্ত্রী থাকলে তারাও সাধারণত যে ঘরে নামাজ পড়ে, সেটা বাদে অন্যান্য ঘরে মাঝে মধ্যে নামাজ পড়বে।
*** প্রতি মাসেই ১/২ বার ঘরে সুরা বাকারা পড়ার চেষ্টা করা। যদিও, কোরআনুল কারিমের সবচেয়ে বড় সুরা এটি। তাই এক দিনে শেষ করতে না পারলে, কয়েক দিনে পড়া। আর তেলাওয়াত করা সম্ভব না হলে ঘরে বসে মনোযোগের সঙ্গে তেলাওয়াতের অডিও শুনা।
*** বাহির থেকে বাড়িতে প্রবেশের সময়‘বিসমিল্লাহ' বলে প্রবেশ করা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দোয়া পড়ে বের হওয়া। ঘরে খাবার আগে 'বিসমিল্লাহ' বলা।
*** ঘরে জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়ার সমস্যা থাকলে 'বিসমিল্লাহ' বলে ড্রয়ারে/আলমারি খোলা এবং বন্ধ করা। ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ঘরের দরজা ও জানালা বন্ধ করা।
*** সকাল-সন্ধ্যা ও অন্যান্য সময়ের সঙ্গে আয়াতুল কুরসিসহ সংশ্লিষ্ট জিকির ও দোয়াগুলো করার অভ্যাস করা।
*** অকারণে ঘরের মধ্যস্থিত টয়লেটের দরজা খুলে না রাখা। টয়লেটে প্রবেশের সময় দোয়অ পড়া।
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের বিশেষ গুরুত্ব- The special importance of the last two verses of Surah Al-Baqarah
সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত ("আমানার রাসুল") থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত। হাদীস শরীফে এসেছে, "মহান আল্লাহ তা'আলা আকাশের নিচে এমন কোনো কিতাব অবতীর্ণ করেননি, যা সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের মতো। যে ব্যক্তি এ দুই আয়াত রাতে পাঠ করবে, তা তার জন্য যথেষ্ট হবে।" (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
এই আয়াতদ্বয় রাতের ঘুমের আগে পাঠ করলে, পুরো রাত্রির নিরাপত্তা, ক্ষমা এবং দোয়ার পূর্ণতা পাওয়া যায়।
সূরা বাকারা আমলের উপকারিতা- Benefits of reciting Surah Al-Baqarah
নিয়মিতভাবে সূরা বাকারা পাঠ করা বা তিলাওয়াত করার অভ্যাস গড়ে তুললে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই বহুগুণ উপকার পাওয়া যায়। নিচে এই সূরা আমলের কিছু উপকারিতার কথা বলা হলো-
** ইমানের বৃদ্ধি- সূরার আয়াতে বারবায় আল্লাহ, ফেরেশতা, আখিরাত ও নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে।
** আল্লাহর রহমত লাভ- যারা আল্লাহর বিধান মেনে চলে, সূরা বাকারা তাদের জন্য এক আলো এবং দিকনির্দেশনা স্বরূপ।
** বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা- শয়তানের প্রভাব, জাদু, হিংসা ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যায়।
** পরিবারে শান্তি- সূরা বাকারার পাঠে ঘরে প্রশান্তি ও রুহানিয়াত নেমে আসে।
শেষ কথা- নাজাতের পথে সূরা বাকারাঃ Last Words - Surah Baqarah on the Path to Salvation
সূরা বাকারা শুধুমাত্র একটি সূরা নয়, বরং এটি একটি জীবনব্যবস্থা। মহা পবিত্র আল কোরয়ানের এই সূরার মধ্যে রয়েছে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা, ইবাদতের রীতি, আত্মশুদ্ধি ও আখিরাতের জন্য প্রস্তুতির দিকনির্দেশনা।
এই সূরার প্রতি আন্তরিক মনোযোগ দিলে যে কোন মুমিন- মুসলমান ব্যক্তি দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি লাভ করতে পারে। তাই, আমাদের সকলের উচিত প্রতিদিন সূরা বাকারার অন্তত কিছু অংশ পাঠ করার অভ্যাস গড়ে তোলা।
এটি শুধু নেকি অর্জনের পথ নয়, বরং পরিবার, সমাজ এবং নিজের আত্মার নিরাপত্তারও মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত আমলগুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। নিজ নিজ ঘরকে শয়তান ও বদজিনের আক্রমণ থেকে মুক্ত রাখুন। আমীন।
আরো পড়ুনঃ ঘুমানোর আগে পড়ার ৫টি দোয়া ও আয়াত – মানসিক শান্তি ও সুরক্ষার আমল
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ- Request to readers
আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লাগে ও উপকারী বলে মনে হয়, তাহলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সাথে, তারাও যেন উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পেজকে ফলোদিন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ। আমাদের Tiretx
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url