আশুরার গুরুত্ব ও মহররম মাসের তাৎপর্য – ইতিহাস, আমল ও শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ

আরো পড়ুনঃ সূরা বাকারার ৬ টি ফজিলত – ঘরকে শয়তান মুক্ত রাখার সেরা আমল

মহররম হলো ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। মহান আল্লাহর নিকট যে ৪টি পবিত্র মাস রয়েছে, এটি হলো পবিত্র মাসের (আশহুরে হুরুম) একটি। যেগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহকে হারাম করা হয়েছে।

আর এই মাসের নামকরণ হয়েছে মূলত “মুহাররম” বা “হারাম” শব্দ থেকে, যার বাংলা অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। কুরআনুল কারিমে এই মাসের কথা উল্লেখ আছে। “আল্লাহ পাকের কাছে মাস গণনা হলো মোট বারটি, এগুলোর মধ্যে চারটি পবিত্র।” (সূরা তাওবা, আয়াত- ৩৬)

ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম আল্লাহ তা'লার নিকট অত্যন্ত সম্মানিত। এই মাসে নেক আমলের সওয়াবকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে ১০ই মহররম বা আশুরা হলো এই মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন।

আশুরা দিবস কী?- What is the Day of Ashura?

“আশুরা” শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “আশারা” থেকে, যার বাংলা অর্থ দশ। তাই, ১০ই মহররমকেই আশুরা বলা হয়। ইসলামী ইতিহাসে আশুরা অন্যতম একটি ব্যতিক্রমী দিন।  এই দিনে ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

মহানবী হজরত মুহান্মদ (সা.) মদীনায় হিজরত করার পর দেখতে পান যে, ইহুদিরা ১০ মহররম রোজা  পালল করছেন। কারণ, এই দিনেই হযরত মূসা (আ.) ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। রাসুলে পাক (সা.) তখন বলেন, 

“আমরা মূসার চেয়েও বেশি হকদার।” (সহীহ বুখারী), এরপর তিনি নিজেও রোজা রাখতেন এবং সাহাবাদেরও রোজা রাখতে বলেন।

আশুরার ঐতিহাসিক পটভূমি কি?- What is the historical background of Ashura?

আশুরার দিনটি বিভিন্ন নবী ও উম্মতের জন্য অনেক তাৎপর্যময় ছিল। ইসলামী বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে,  আশুরার দিন বা মহরম মাসের ১০ তারিখে-

  • হযরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়।
  • হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে।
  • হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুন থেকে উদ্ধার করা হয়।
  • হযরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারিয়ে যাওয়া প্রিয় সন্তান হযরত ইউসুফ (আ.)-কে ফিরে পান।
  • হযরত আইয়ুব (আ.) দূরাগ্য রোগ থেকে মুক্ত হন।
  • হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে বেরিয়ে আসেন।

উপরের সব ঘটনার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য হলো, হযরত মূসা (আ.) এবং তাঁর জাতিদের বা অনুসারীদের ফেরাঊনের জুলুম থেকে মহান আল্লাহ পাক মুক্ত করে ছিলেন পবিত্র এই দিনেই।

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা- The heartbreaking events of Karbala

আশুরা কথা বলতেই আমদের মনে পড়ে, ইসলামের সবচেয়ে করুণ ইতিহাস, কারবালার প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাত বরণের কথা।

৬১ হিজরিতে, ইয়াজিদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন হযরত আলী (রা.) এর পুত্র এবং মহানবী (সা.) দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)। এই কারণে, তিনি মদিনা মনোয়ারা থেকে মক্কা হয়ে কারবালায় পৌঁছান। 

সেখানেই ইয়াজিদের সৈন্যরা (কারবালার প্রান্তরে) তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং পানিহীন রেখে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এই ঘটনাটি ইসলামী ইতিহাসে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়।

আশুরার দিনে করণীয় আমল কি?- What are the deeds to be done on the Day of Ashura?

রাসুলে পাক (সা.) আশুরার দিনে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল করার জন্য সাহাবায়ে কিরামদের উৎসাহিত করেছেন। নিম্নে সেই আমলগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হক-

আশুরার দিনে রাসুল (সা.) যে আমল করতে উৎসাহিত করেছেন- The deeds that the Prophet (peace be upon him) encouraged to do on the Day of Ashura

** রোজা রাখা- আশুরার দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো রোজা রাখা। হাদীস শরীফে এসেছে, “আশুরার রোযার ফজিলত হলো, এটি গত বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়।” (মুসলিম: ১১৬২)

** তাসু’আ (৯ই মহররম) ও আশুরা (১০ই মহররম) একসাথে রোজা রাখা- রাসুলে পাক (সা.) ইহুদিদের থেকে ভিন্নতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে, মুসলমাদের ৯ ও ১০ মহররম অথবা ১০ ও ১১ মহররম দুই দিন রোজা রাখতে বলেছেন। (মুসলিম: ১১৩4)

** পরিবার-পরিজনের জন্য খাবার ও খরচে কিছুটা বাড়তি করা- রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পবিত্র আশুরার দিনে নিজের পরিবার-পরিজনের উপর খরচ প্রসারিত করবে, মহান আল্লাহ তাআলা তার রিজিকে, সারা বছর ব্যাপকতা দান করবেন।” (বাইহাকি: শুঅাবুল ঈমান)

আরো পড়ুনঃ নারীদের পর্দা- ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক বাস্তবতা

** তাওবা ও ইস্তেগফার করা- আশুরা হলো গোনাহ মাফের জন্য অন্যতম একটি দিন। তাই, আশুরার দিনে বেশি বেশি করে তাওবা ও ইস্তেগফার করা সুন্নত।

** নফল নামাজ আদায় করা- যদিও, এই দিনের নির্দিষ্ট কোনো নামাজ সম্পর্কে হাদীসে নির্ধারিত কিছু উল্লেখ নেই, তবে নফল নামাজ আদায় করে ইবাদতের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।

** কুরআন তেলাওয়াত করা ও জিকির করা- যেহেতু, এই দিনটি অনেক ফজিলতপূর্ণ, তাই এই দিনে কুরআন তেলাওয়াত, দোয়া ও জিকির করা খুবই পুণ্যময়।

** গরীব-মিসকিনকে দান করা- এই দিনে সদকা ও দান করার অনেক ফজিলত রয়েছে, তাছাড়া দান সামাজিক সহানুভূতির অন্যতম প্রতীক।

** উল্লেখ্য- আশুরা উপলক্ষে শোক পালন বা বিদআতমূলক কাজ যেমন মাতম, রক্তপাত, বেদনা জাহির ইত্যাদি ইসলাম সম্মত নয়।

আশুরার দিনে যা বর্জনীয়- What is to be avoided on the Day of Ashura

আশুরা দিনটি একটি পবিত্র ও ফজিলতপূর্ণ দিন। তাই, এই দিনে এমন কিছু কাজ রয়েছে, যা ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বর্জনীয় বা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত। এই সম্পর্কে সংক্ষেপে নিচে তা তুলে ধরা হলো- 

বিদআতমূলক শোক পালন- মাতম করা, শরীরকে রক্তাক্ত করা, ছুরি-চাকু দিয়ে আঘাত করা, কপাল কাটা ইত্যাদি করা হারাম। 

আত্মবিলাপ বা কান্নাকাটি করে বুক চাপড়ানো- রাসুলে পাক (সা.) বলেন, "আমরা নই সেই দল, যারা মুখ ছিঁড়ে, জামা ছিঁড়ে, জাহিলিয়াতের মতো বিলাপ করে।" (বুখারী ও মুসলিম) 

আশুরাকে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালনে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি- তবে, ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে শোক পালনকে সীমিত সময়ের জন্য বৈধ (তিন দিন) করেছে। তাই, আশুরাকে উপলক্ষে দীর্ঘস্থায়ী শোক বা বার্ষিক শোকের রীতি বিদআত। 

আশুরাকে উৎসব হিসেবে পালন- বিশেষভাবে ভালো খাবার পরিবেশন, সাজগোজ করা এবং মিষ্টি বিতরণ করে উৎসব পালন করা বিদআত। 

সুনির্দিষ্ট পোশাক বা কালো কাপড় পরিধান করে শোকের প্রতীক বানানো- ইসলামে এই ধরনের কোন পোশাক পরা বাধ্যতামূলক বা সুন্নত নয়। 

ইতিহাস বিকৃত করে মিথ্যা গল্প ও বানোয়াট ঘটনা প্রচার- ইমাম হুসাইনের (রা.) এর শাহাদাতের ঘটনার অতিরঞ্জন করা, মনগড়া ঘটনা বর্ণনা করা, এসব থেকেও আমাদের বিরত থাকা জরুরি।

আশুরা থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত?- What lessons should be learned from Ashura?

আশুরা বা ১০ মহরম আমাদের সামনে তুলে ধরে ত্যাগ, ধৈর্য, ন্যায় এবং ঈমানের দৃঢ়তার আদর্শ হিসাবে। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) আমাদের শিক্ষা দেন, 

  • অন্যায়ের সাথে আপস নয়।
  • সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকা।
  • জুলুমের বিরুদ্ধে সাহসিকতা দেখানো।
এছাড়াও, বিভিন্ন নবীদের ঘটনাবলি থেকেও আমরা শিখি যে, আল্লাহ সবসময় ধৈর্যশীলদের সাহায্য করেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আশুরা পালন?- Observing Ashura in the context of Bangladesh?

বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আশুরার দিনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিন হিসেবে পালন করা হয়। তবে, শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ভিন্নভাবে করে থাকে। যেমন-

সুন্নি মুসলমানদের আশুরা পালন- Sunni Muslims observe Ashura

  • আশুরার দিন নফল রোজা রাখা, কুরআন তেলাওয়াত, ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া করা হয়।
  • হযরত মূসা (আ.) ও ইমাম হুসাইন (রা.)-এর ঘটনাগুলো স্মরণ করা হয় ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে।
  • অনেকে এই দিনে গরীবদের খাওয়ানো ও দান-সদকা করেও পুণ্য লাভের চেষ্টা করেন।

শিয়া মুসলমানদের আশুরা পালন- Shia Muslims observe Ashura

  • ইমাম হুসাইন (রা.)-এর কারবালার শহীদত্বকে কেন্দ্র করে তাজিয়া মিছিল, মাতম, নানান শোকানুষ্ঠান পালন করা হয়।
  • ঢাকা শহরের হোসেনি দালান থেকে ঐতিহাসিক তাজিয়া মিছিল বের হয়, যা বহু বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী একটি কর্মসূচি।

সরকারি আশুরা পালন- Official Ashura observance

  • বাংলাদেশে আশুরা উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
  • বিভিন্ন টিভি ও রেডিওতে আশুরার তাৎপর্য নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।
  • আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকার বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

শেষকথা- আশুরার ইতিহাস জীবিন্ত একটি শিক্ষা- Conclusion - The history of Ashura is a living lesson

আশুরার দিন কোনো শোক পালন বা কেবল ইতিহাস নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত শিক্ষা। এটি আমাদের ন্যায় ও সত্যের পথে অবিচল থাকার প্রতীক। নবী মূসা (আ.)-এর মুক্তি থেকে শুরু করে ইমাম হোসাইন (রা.)- এর শাহাদাত পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়,

  • ধৈর্য ধারণ করুন।
  • সত্যের পক্ষে দাঁড়ান।
  • আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।

তাই, আসুন আমরা সকলে, আশুরা ও মহররম মাসের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝার চেস্টা করি এবং সেটি আমল করি। বিদআতকে পরিহার করে কুরআন-হাদীসের আলোকে, এই মাসকে সম্মান করি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দান করুন, আমিন।

আরো পড়ুনঃ ৫ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব ও উপকারিতা – নামাজ কেন জীবন বদলায় জানুন 

পাঠকদের প্রতি অনুরোধ- Request to readers

আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লাগে ও উপকারী বলে মনে হয়, তাহলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সাথে, তারাও যেন উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পেজকে ফলোদিন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ। আমাদের Tiretx

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url