ঘুমানোর আগে পড়ার ৫টি দোয়া ও আয়াত – মানসিক শান্তি ও সুরক্ষার আমল
আরো পড়ুনঃ পরীক্ষায় সফলতার জন্য ৫টি দোয়া – পরীক্ষার্থীদের জন্য ইসলামী সমাধান
ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলেও, ইসলামের দৃষ্টিতে এটি শুধুমাত্র বিশ্রাম নয়, বরং মহান আল্লাহর অনেক বড় একটি বিশেষ নিয়ামত।
তাই ঘুমানোর আগে কিছু দোয়া ও আয়াত পাঠ করা আমাদের আত্মিক সুরক্ষা, মানসিক প্রশান্তি এবং শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন জেনে নিই ঘুমের পূর্বে কী দোয়া ও আমল করা উচিত।
ঘুমানোর আগে কেন দোয়া পড়া উচিত?- Why should you pray before going to bed?
"ঘুম" বা বিশ্রাম যদিও সকল প্রাণী জগতের বিশেষ করে, আমাদের মানুষের জীবনের অন্যতম প্রধান একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে, ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, ঘুম কেবলমাত্র বিশ্রামের মাধ্যম নয়, বরং এটি আল্লাহর দেওয়া বড় একটি নিয়ামত।
তাই, ঘুমানোর পূর্বে দোয়া ও আয়াত বা কিছু নির্দিষ্ট আমলের মাধ্যমে আমরা নিজেদের আত্মাকে মহান আল্লাহর জিম্মায় সোপর্দ করি, যা আমাদের নিরাপত্তা ও মানসিক প্রশান্তির জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদীস শরীফে এসেছে, “তোমাদের কেউ যখন ঘুমাতে যায়, তখন যেন সে বলে, ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া’' অর্থ হে আল্লাহ! আপনারই নামে আমি মৃত্যু বরণ করি এবং জীবিত হই। (বুখারী)
কোরআন ও হাদীসে ঘুমানোর আমলের ফজিলত- The virtues of sleeping in the Quran and Hadith
হাদীস মতে ঘুমের পূর্বে আমলের গুরুত্ব- The importance of prayer before sleep according to the Hadith
হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করচ্যেন, “রাসূল পাক (সা.) প্রতি রাতে যখন ঘুমতে যেতেন, তখন তিনি ঘুমানোর পূর্বে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে নিজ দেহে/ শরীরে ফুঁ দিতেন।” (সহীহ বুখারী)
ঘুমের পূর্বে সাহাবীদের আমল- The deeds of the companions before sleep
সাহাবারা রাতে ঘুমাতে জাওয়ার আগে আয়াতুল কুরসী, তাসবিহ, ও দোয়া নিয়মিত পড়তেন। কেননা, এই অভ্যাস তাদেরকে মহান আল্লাহর নৈকট্যে রাখার পাশাপাশি শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে তাদেরকে রক্ষা করত।
ঘুমানোর আগে পড়ার দোয়া- Prayer to read before sleeping
নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও আয়াত বা আমল তুলে ধরা হলো, যা ঘুমানোর পূর্বে পাঠ করলে মানসিকভাবে যেমন শান্তি মেলে, তেমনিভাবে ভয় থেকে মুক্তি এবং আত্মার সুরক্ষা লাভ করা যায়। যেমন-
আয়াতুল কুরসী – সুরা আল-বাকারা ২৫৫- Ayatul Kursi – Surah Al-Baqarah 255
আয়তুল কুরসী আরবি আয়াত- Ayatul Kursi Arabic Verse
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
আয়তুল কুরসী বাংলা উচ্চারণ- Ayatul Kursi Bengali pronunciation
আল্লাহু লা-ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়্যুম, লা তা'খুযুহু সিনাতুঁ ওয়ালা নাওম, লাহু মা ফিস্-সামা-ওয়াতি ওয়া মা ফিল আরদ, মান যাল্লাযী ইয়াশফাউ 'ইন্দাহূ ইল্লা বিইযনিহি, ইয়ালামু মা বায়না আইদীহিম ওয়া মা খলফাহুম, ওয়া লা ইউহীতূন বিছাইইম্-মিন ইলমিহি ইল্লা বিমা শা', ওয়া সি'আ কুরসীয়্যুহুস্-সামা-ওয়াতি ওয়াল আরদ, ওয়া লা ইয়াউদুহু হিফ্ঝুহুমা, ও হুয়াল আলিইউল আজিম।
আয়তুল কুরসী বাংলা অর্থ- Ayatul Kursi Bengali meaning
আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে—সবই তাঁর। কে আছে, যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করতে পারে? তিনি জানেন যা কিছু তাদের সামনে ও তাদের পেছনে আছে।
আর তারা তাঁর জ্ঞানের কোনো অংশ আয়ত্ত করতে পারে না, তিনি যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া। তাঁর কুরসী (সিংহাসন) আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে শামিল করে আছে, আর এই দুটির হেফাজত তাঁকে ক্লান্ত করে না। আর তিনি পরম উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, মহান।
ঘুমানোর আগে আয়তুল কুরসী পাঠের ফজলত- The virtue of reciting Ayatul Kursi before sleeping
হাদীসে শরীফে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসী পড়ে ঘুমাবে, তার উপর সেই রাতে কোনো শয়তান আসতে পারে না। (সহীহ বুখারী)
সূরা ইখলাস- Surah Ikhlas
সূরা ইখলাস আরবি- Surah Ikhlas Arabic
قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌ
সূরা ইখলাস বাংলা উচ্চারণ- Surah Ikhlas Bengali pronunciation
কুল হুয়াল্লা-হু আহাদ। আল্লা-হুস্ সামাদ। লাম ইয়ালিদ্ ওয়া লাম ইউলাদ। ওয়া লাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।
সূরা ইখলাস বাংলা অর্থ- Surah Ikhlas Bengali meaning
বলুন, তিনিই আল্লাহ, একমাত্র। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই।
সূরা ইখলাস পাঠের ফজিলত- The virtue of reciting Surah Ikhlas
সূরা আল ফালাক- Surah Al Falaq
সূরা আল ফালাক আরবি- Surah Al Falaq Arabic
সূরা আল ফালাক বাংলা উচ্চারণ- Surah Al Falaq Bengali Pronunciation
সূরা আল ফালাক বাংলা অর্থ- Surah Al Falaq Bengali meaning
বলুন, আমি আশ্রয় চাই প্রভাতের প্রতিপালকের। তাঁর সৃষ্ট জিনিসের অনিষ্ট থেকে। অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা বিস্তার লাভ করে। গাঁথা-মন্ত্রকারিণীদের অনিষ্ট থেকে। আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।
সূরা আল ফালাকের ফজিলত- The virtues of Surah Al-Falaq
সূরা আন-নাস- Surah An-Nas
সূরা আন-নাস আরবি- Surah An-Nas Arabic
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلنَّاسِ مَلِكِ ٱلنَّاسِ إِلَٰهِ ٱلنَّاسِ مِن شَرِّ ٱلْوَسْوَاسِ ٱلْخَنَّاسِ ٱلَّذِى يُوَسْوِسُ فِى صُدُورِ ٱلنَّاسِ مِنَ ٱلْجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ
সূরা আন-নাস বাংলা উচ্চারণ- Surah An-Nas Bengali pronunciation
কুল আঊযু বিরাব্বিন নাস। মালিকিন নাস। ইলাহিন নাস। মিন শাররিল ওয়াসওয়াসিল খান্নাস। আল্লাযি ইউওয়াসওয়িসু ফি সুদূরিন নাস। মিনাল জিন্নাতি ওয়ান নাস।
সূরা আন-নাস বাংলা অর্থ- Surah An-Nas Bengali meaning
বলুন, আমি আশ্রয় চাই মানুষের রবের নিকট। মানুষের অধিপতির নিকট। মানুষের ইলাহর নিকট।ওয়াসওয়াসা দানকারী আত্মগোপনকারী শয়তানের অনিষ্ট থেকে। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জিন ও মানুষের মধ্য থেকে।
সূরা আন-নাসের ফজিলত- The virtues of Surah An-Nasr
সূরা আন-নাস আমাদের অদৃশ্য শত্রু, যেমন: শয়তানের কুমন্ত্রণা, হিংসা, জ্বিন, এসব থেকে রক্ষা করে। রাসূল (সা.) বলেন, “ঘুমানোর আগে সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়ে নিজের শরীরে ফুঁ দাও।” (সহীহ বুখারী)
এটি রূহানী সুরক্ষা ও মানসিক প্রশান্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। প্রতিদিন সকালে, রাতে এবং ঘুমের আগে এই সূরাটি পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঘুমানোর দোয়া- Prayer to sleep
ঘুমানোর দোয়া আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ- Prayer for sleeping in Arabic, Bengali pronunciation and meaning
- আরবী- اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا
- বাংলা উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া।
- বাংলা অর্থ- “হে আল্লাহ! আপনারই নামে আমি মৃত্যু বরণ করি এবং জীবিত হই।”
ঘুমানোর দোয়া পাঠের ফজিলত- The virtue of reciting a prayer before going to sleep
এই দোয়াটি রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমানোর পূর্বে পাঠ করতেন। হাদীসের মধ্যে এসেছে, “যখন তুমি বিছানায় যাবে, তখন এ দোয়াটি পড়বে। (সহীহ বুখারী, হাদিস ৬৩২৪), এই দোয়ার মাধ্যমে একজন মুসলমান নিজেকে আল্লাহর জিম্মায় সঁপে দিয়ে ঘুমায়, যা আত্মিক প্রশান্তি ও নিরাপত্তা দেয়।
ছোট শিশুদের জন্য ঘুমানোর দোয়া- Sleeping prayer for small children
- আরবী- اللَّهُمَّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ
- বাংলা উচ্চারণ- আল্লাহুম্মা কিনি আযাবাকা ইয়াওমা তাব'আছু ইবাদাকা।
- বাংলা অর্থ- “হে আল্লাহ! আপনার বান্দাদের পুনরুত্থানের দিন আপনি আমাকে আপনার শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।”
- গুরুত্ব- ছোট শিশুদের জন্য সহজ ও ছোট আয়াত বা দোয়া শেখানো অভ্যাসে পরিণত করলে তা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়।
ঘুমানোর দোয়া পাঠের উপকারিতা- Benefits of reciting a prayer before sleeping
** মানসিক শান্তি- ঘুমানোর আগে দোয়া পড়লে মস্তিষ্কে শান্তির হরমোন নিঃসরণ হয়, ফলে ঘুম গভীর ও আরামদায়ক হয়।
** দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি- হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি আয়াতুল কুরসী বা সূরা নাস পড়ে ঘুমায়, সে দুঃস্বপ্ন থেকে নিরাপদ থাকে।
** জ্বিন বা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা- নবী করিম (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতে আয়াতুল কুরসী পড়ে, তার ওপর সারা রাত আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন পাহারাদার নিযুক্ত থাকেন।” (সহীহ বুখারী)
ঘুমের আগে আমল করার ৫টি সুন্নত- 5 Sunnahs to practice before sleeping
** ওজু করে ঘুমানো- রাসূলুল্লাহ (সা.) ওজু করে ঘুমাতেন। এটি পবিত্র অবস্থায় ঘুমানোর সুন্নত এবং নেকি লাভের পথ।
** ডান কাত হয়ে শোয়া- নবী করিম (সা.) ঘুমানোর সময় ডান কাত হয়ে শুতেন এবং হাতের তালুর ওপর মাথা রাখতেন।
** দোয়া ও তাসবিহ পাঠ- ঘুমের আগে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ এই তাসবিহগুলো ৩৩ বার করে পড়া সুন্নত।
** বিছানা ঝেড়ে নেয়া- নবী করিম (সা.) ঘুমানোর পূর্বে বিছানা ঝেড়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে কোনো ক্ষতিকর কিছু না থাকে।
** নাম নির্দিষ্ট করে দোয়া করা- আল্লাহর কাছে নিজের সমস্যা, ভয় বা চাহিদার বিষয়ে দোয়া করা সুন্নত ও প্রিয় কাজ।
পরিশেষে: শান্তিময় ঘুমের জন্য ইসলামের বিধান- Finally: Islamic rules for peaceful sleep
ইসলাম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গাইডলাইন দিয়েছে, তাই ঘুমের মতো সহজ কাজেও রয়েছে, দোয়া, আমল ও ফজিলতের নির্দেশনা। প্রতিদিন ঘুমানোর পূর্বে কয়েক মিনিট সময় বের করে এই আমলগুলো করলে আল্লাহর রহমত লাভ হয়, আত্মা শান্তি পায় এবং আমাদের রাতের সময় হয়ে উঠে নিরাপদ ও বরকতময়।
আরো পড়ুনঃ শবে কদরের রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত
আমরা যদি, নিয়মিত এই আমলগুলোর চর্চা করি, তাহলে এর মাধ্যমে আমাদের শুধু দৈহিক বিশ্রামই হবে না, বরং আত্মিক প্রশান্তি ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
পাঠকদের প্রতি অনুরোধ- A request to the readers
এই দোয়াগুলো আপনি নিজে আমল করুন এবং পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে শিশুদেরকেও শেখান, যাতে তারা যেন, ছোট বয়স থেকেই আল্লাহর স্মরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। এমন আরো নতুন নতুন তথ্য জানতে আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url