নামাজ না পড়ার পরিণতি – কোরআন ও হাদীসের আলোকে- The consequences of not praying – in the light of the Quran and Hadith

আরো পড়ুনঃ কেয়ামতের দিন মানুষের হিসাব নেওয়ার পদ্ধতি – জান্নাত ও জাহান্নামের বাস্তব চিত্র

নামাজ না পড়ার ভয়াবহ পরিণতি কী? কোরআন ও হাদীসের আলোকে জানুন দুনিয়া ও আখেরাতে কী শাস্তি অপেক্ষা করছে। সময় থাকতে নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও করুন।

কোরআন ও হাদিস মতে নামাজ না পড়ার পরিণতি

নামাজ ইসলাম ধর্মের যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে, তারমধ্যে দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ। এটি কেবলমাত্র একটি রিচুয়াল নয়—বরং একজন মুসলমানের ঈমান ও আল্লাহর সাথে সম্পর্কের পরিচয়।

কিন্তু, দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, আজকাল অনেক মুসলমান ইচ্ছা করেই নামাজ ত্যাগ করছে কিংবা গুরুত্বহীনভাবে নিচ্ছে। কেউ বলে “সময় পাই না”, কেউ বলে “মন বসে না”—এসব অজুহাত কিন্তু আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। কোরআন ও হাদীস আমাদেরকে এই বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে।

কোরআনের আলোকে নামাজের গুরুত্ব

নামাজ ঈমানের প্রতীক

আল্লাহ তাআলা বলেন-

** আরবি আয়াত- الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ

** বাংলা উচ্চারণ- আল্লাজীনা ইউ’মিনূনা বিল-গাইবি ওয়া ইউকীমূনাস্ সালাতা ওয়া মিম্মা রাযাকনাহুম ইউনফিকূন।

** বাংলা অনুবাদ- "যারা গায়েবের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।" (সূরা বাকারা, আয়াত-৩)

উপরে উল্লেখিত আয়াতটি আমাদের দেখিয়ে দেয়, নামাজ ঈমানের একটি আবশ্যিক অনুষঙ্গ।

নামাজ না পড়লে জাহান্নাম অনিবার্য:

** আরবি আয়াত- مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ ﴿٤٢﴾ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ ﴿٤٣﴾

** বাংলা উচ্চারণ- মা সালালালুম ফি সাকার। ক-লু লাম নাকু মিনাল মুসলিমিন

** বাংলা অনুবাদ- “তোমাদের কী জিনিস সাউকার (জাহান্নাম) এ নিয়ে এসেছে?” তারা বলবে: “আমরা নামাজ পড়তাম না।” (সূরা মুদাসসির, আয়াত- ৪২ ও ৪৩)

আল্লাহর পক্ষ থেকে ধ্বংসের হুমকি

** আরবি আয়াত- فَخَلَفَ مِنۢ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُوا۟ ٱلشَّهَوَٰتِ ۖ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا

** বাংলা উচ্চারণ- "ফাখালাফা মিন্ বা‘দিহিম্ খাল্ফুন্ আদ্বা‘উস্ সালাতা, ওয়াত্তাবা‘উশ্ শাহাওয়াত, ফাসাওফা ইয়ালকাওনা গাইয়্যা"।

** বাংলা অনুবাদ- "অতঃপর তাদের পর এমন এক প্রজন্ম এসেছে, যারা নামাজ পরিত্যাগ করেছে এবং খেয়াল-খুশির অনুসরণ করেছে। সুতরাং শিগগিরই তারা গোমরাহিতে নিপতিত হবে।"  (সূরা মারইয়াম, আয়াত- ৫৯)

** আরবি আয়াত- فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ ۝ الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ

** বাংলা উচ্চারণ- ফাওয়াইলুল্ লিল্ মুসল্লীন। আল্লাযীনা হুম ‘আন্ সালাতিহিম্ সাহূন।

** বাংলা অনুবাদধ্বংস তাদের জন্য, যারা নামাজ পড়ে, কিন্তু যারা তাদের নামাজে গাফেল। বা “সুসংবাদ নয়, ধ্বংস তাদের জন্য যারা নামাজে গাফেল।” (সূরা মা'ইন, আয়াত- ৪ ও ৫)

সুতরাং এই আয়াতগুলো পড়লেই বোঝা যায় যে, নামাজ না পড়া বা অবহেলা করার পরিণতি কত ভয়াবহ!

হাদীসের আলোকে নামাজ না পড়ার পরিণতি

রাসূল (সা.) বলেছেন-

“আমাদের ও তাদের (অবিশ্বাসীদের) মধ্যে পার্থক্য হলো নামাজ। যে ব্যক্তি নামাজ ত্যাগ করে, সে কুফরী করলো।” (তিরমিজি ২৬২১)

নামাজ ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেওয়া কুফরি 

“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এক ওয়াক্ত নামাজ ত্যাগ করলো, তার উপর থেকে আল্লাহর হিফাজত উঠে গেল।” (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা)

হাশরের ময়দানে প্রথম প্রশ্ন হবে নামাজ নিয়ে

“প্রথমেই বান্দার নামাজের হিসাব নেয়া হবে। যদি তা সঠিক হয়, তবে তার সকল আমল সহজ হয়ে যাবে।” (আবু দাউদ- ৮৬৪)

জাহান্নামের ভয়ংকর চিত্র ও নামাজহীনদের শাস্তি

আগুনে পোড়া ও পুনরায় সৃষ্টি

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

** আরবি আয়াত- إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِنَا سَوْفَ نُصْلِيهِمْ نَارًا ۚ كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُم بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا لِيَذُوقُوا الْعَذَابَ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَزِيزًا حَكِيمًا

** বাংলা উচ্চারণ- ইন্নাল্লাযীনা কাফারূ বিআআয়াতিনা সৌফা নুসলীহিম নারা, কুল্লামা নাযিজাত জুলূদুহুম বাদ্দালনাহুম জুলূদান্ গাইরাহা লি-যুজীকুল আযাব। ইন্নাল্লাহা কানাআ'যীযান হাকীমা।

** বাংলা অনুবাদ- নিশ্চয়ই যারা আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছে, আমি তাদেরকে অচিরেই আগুনে নিক্ষেপ করব। যখনই তাদের চামড়া পুড়ে যাবে, তখনই আমি তাদের পরিবর্তে অন্য চামড়া সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি আস্বাদন করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিসা, আয়াত- ৫৬)

নামাজহীনদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ‘সাউকার’

** আরবি আয়াত- مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ ۝ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ

** বাংলা উচ্চারণ- মা সালাকাকুম ফী সাকার। ক্বালু লাম নাকু মিনাল মুসাল্লীন।

** বাংলা অনুবাদ- “সাউকার” এমন একটি জাহান্নামী স্থান যেখানে নামাজহীন ব্যক্তিরা থাকবে।” (সূরা মুদ্দাসসির, আয়াত ৪২ ও ৪৩)

আরো পড়ুনঃ শেষ জামানার লক্ষণ ২০২৫ – কেয়ামতের আগে যে নিদর্শনগুলো প্রকাশ পাবে

চেহারা কালো করা হবে

“যে নামাজ ত্যাগ করলো, তার মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে, চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, এবং সে শয়তানের সঙ্গী হিসেবে resurrect হবে।” (ইবনে মজাহ)

দুনিয়ার জীবনে নামাজ না পড়ার ক্ষতি

আত্মিক অস্থিরতা ও মানসিক চাপ

নামাজ মানুষকে আল্লাহর স্মরণ করায়। আল্লাহ পাক বলেন-

** আরবি আয়াত- أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

** বাংলা উচ্চারণ- আলা বিজিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল কুলূব।

** বাংলা অনুবাদ- নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ শান্তি লাভ করে। (সূরা রা'দ, আয়াত- ২৮)

এই আয়াতটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার সব অস্থিরতা, চিন্তা ও উদ্বেগের একমাত্র শান্তি ও প্রশান্তির উৎস হলো আল্লাহর জিকির – তাঁর নাম স্মরণ করা, তাঁকে ডাকাডাকি করা।

পরিবারের অশান্তি-

যেখানে নামাজ থাকে না, সেখানে আল্লাহর রহমত থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়। শান্তি ও বরকত সরে যায়, অশান্তি ও বিপদ বাড়ে। নামাজহীন জীবনে আত্মিক প্রশান্তি ও আলোকিত পথনির্দেশ পাওয়া যায় না।

গুনাহে জড়িয়ে পড়া সহজ হয়

নামাজ মানুষকে অন্যায়, অশ্লীলতা ও পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। নামাজ না পড়লে অন্তর অন্ধকার হয়ে যায়, ফলে সহজেই গুনাহের পথে পা বাড়ায় মানুষ। আত্মিক অবক্ষয় শুরু হয় নিঃশব্দে।

নামাজ ছাড়ার সাধারণ কারণ

নামাজ ছাড়ার পেছনের সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অলসতা, সময়মতো আদায় না করা, নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা, দুনিয়াবি ব্যস্ততা, শয়তানের কুমন্ত্রণা, এবং রোগের কারণে শারীরিক দুর্বলতা। 

এছাড়াও, কিছু মানুষ নামাজকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে না দেখে, এটিকে ঐচ্ছিক মনে করে, যা নামাজ ছাড়ার একটি বড় কারণ। নামাজ ছাড়ার পেছনের কিছু সাধারণ কারণ নিচে ছকে উল্লেখ করা হলো-

কারণ                     ব্যাখ্যা
অলসতা        অনেকেই বলে "কাল থেকে শুরু করবো", কিন্তু কাল আর আসে না।
সময়ের অভাব        কিন্তু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মাত্র ৩০–৪০ মিনিট সময় নেয়। 
গাফলতি       আল্লাহর ভয় ও পরকালের চিন্তা না থাকা।
পরিবেশ       নামাজহীন পরিবার বা বন্ধুবান্ধব।
শয়তানের ধোঁকা       “আল্লাহ তো মাফ করে দেবেন”—এই ভ্রান্ত ধারণা।

সমাধান ও করণীয়

নিজে থেকে নিয়ত করুন

“আজ থেকে কোনো নামাজ বাদ দেবো না – ইনশাআল্লাহ। পাঁচ ওয়াক্ত সময়মতো আদায় করবো, কারণ এতে রয়েছে আমার দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তি ও সফলতা।”

ফজরের নামাজ দিয়ে শুরু করুন

ফজরের নামাজের অভ্যাস গড়ে তুললে আত্মনিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়, দিন শুরু হয় বরকতে। ফলে বাকি নামাজগুলো সময়মতো আদায় করা সহজ হয়ে যায় এবং নিয়মিততা তৈরি হয়।

পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করুন

প্রয়োজনে ঘরেই জামাত করুন, পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিন। এতে ঘরে বরকত নেমে আসে, ইমান মজবুত হয় এবং সন্তানদের নামাজের প্রতি ভালো অভ্যাস গড়ে ওঠে।

নামাজের ফজিলত ও শাস্তির আলোচনা শুনুন

ইসলামিক লেকচার, ভিডিও বা হালাকা শুনলে ঈমান জাগে, হৃদয় নরম হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরতে উৎসাহ আসে। প্রতিদিন কিছু সময় এভাবে কাটান আত্মশুদ্ধির জন্য।

নেক সঙ্গী নির্বাচন করুন

নামাজি বন্ধুদের সংস্পর্শে থাকলে তাদের আমল দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া যায়। ফলে নিজের মধ্যেও নামাজের প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় – ইনশাআল্লাহ।

একটি বাস্তব উদাহরণ

একজন যুবক, দীর্ঘ ১০ বছর নামাজ পড়েনি। একদিন এক বন্ধু তাকে কিয়ামতের দিনের একটি বর্ণনা শুনায়। সে ভয় পেয়ে নামাজ শুরু করে দেয়। আজ সে মসজিদের একজন নিয়মিত মুসল্লি। আপনার জীবনেও এমন একটি পরিবর্তন আসতে পারে—শুধু একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে।

তওবার দরজা সবসময় খোলা

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

** আরবি আয়াত- قُلْ يَا عِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسْرَفُوا۟ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا۟ مِن رَّحْمَةِ ٱللَّهِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغْفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلْغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ

** বাংলা উচ্চারণ- কুল্ ইয়়া ইবাদিয়াল্লাযীনা আসরাফূ ‘আলা আনফুসিহিম লা তাকনাতূ মির রাহমাতিল্লাহ্‌; ইন্নাল্লাহা ইয়াগফিরুয্-যুনূবা জামী‘আ; ইন্‌নাহূ হুয়াল গাফূরুর রাহীম।

** বাংলা অনুবাদ- বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর সীমা অতিক্রম করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা জুমার, আয়াত ৫৩)

শেষকথা- জান্নাতের পথ নামাজ

নামাজ হলো জান্নাতে যাওয়ার পথ, আর নামাজ ত্যাগ জান্নামের রাস্তা। তাই, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ না পড়ে, তবে তার জন্য ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে। আর যারা নামাজ পড়েন, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সু-সংবাদ ও অন্তরের প্রশান্তি।

আরো পড়ুনঃ ইসলামে নারীর অধিকার – কোরআন ও হাদীস অনুযায়ী ভুল ধারণার স্পষ্ট জবাব

আসুন, আমরা সবাই নিজে নামাজ পড়ি, পরিবারকে উৎসাহিত করি এবং সমাজে এই বিষয়ে সচেতনতা ছড়াই। আপনি যদি এই লেখাটি পড়েও নামাজে ফিরে আসেন, তবে আমাদের এই প্রয়াস সফল। দয়া করে এটি শেয়ার করুন—হয়তো কারও জীবনে পরিবর্তন আনবে। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url