করোনা ভাইরাস- লক্ষণ, সংক্রমণ ও প্রতিরোধে ঘরোয়া উপায়
আরো পড়ুনঃ হরমোন কি? হরমোনের সমস্যা কেন হয়?। ঘরোয়া উপায়ে হরমোন সমস্যা সমাধান
করোনা ভাইরাস রোগ বা COVID-19 বর্তমান আধুনিক সময়ের অন্যতম এক ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
এই রোগটি ২০১৯ সালের শেষের দিকে, চীনের উহান শহর থেকে এর সূচনা হলেও, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এই ভাইরাসে শত শত কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং যা মানব সভ্যতার এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে।
এই রোগে কেবল শারীরিক নয়, মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও বিশ্ব মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করেছে। আজকের আর্টিকেলে আমরা জানব, করোনা ভাইরাস কী?, এই ভাইরাসের লক্ষণ সমূহ, সংক্রমণের কারণ এবং কীভাবে ঘরোয়া উপায়ে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব সেই সম্পর্কে। চলুন তাহলে আমরা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে জানি-
করোনা ভাইরাস/ রোগ কী?- What is the coronavirus/disease?
করোনা বা COVID-19 একটি সংক্রামক রোগ, যা SARS-CoV-2 (Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2) নামক ভাইরাস এর মাধ্যমে সৃষ্ট। এটি সাধারণত মানুষের শ্বাসতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং হালকা জ্বর থেকে শুরু করে গুরুতর নিউমোনিয়া পর্যন্ত হতে পারে। এই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে অতি সহজে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক পরিণতির সৃষ্টি করতে পারে।
২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনা ভাইরাস বা রোগকে বিশ্বের একটি মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রায় সকল দেশই একাধিকবার লকডাউন, কোয়ারান্টাইন এবং নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছিল।
করোনার সংক্রমণের কারণ কি?- What causes corona infection?
করোনা ভাইরাস বা রোগ মূলত একজন সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যজনের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। নিচে এই সংক্রমণের প্রধান কারণগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
** ড্রপলেট ট্রান্সমিশন বা ফোঁটা সংক্রমণ- আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি এমনকি কথা বলার সময় মুখ থেকে যে ক্ষুদ্র জলীয় কণা বা ড্রপলেট বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, এই ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাসটি তার কাছাকাছি থাকা অন্য ব্যক্তির নাক, মুখ বা চোখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
** স্পর্শ দ্বারা সংক্রমণ- কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো বস্তু স্পর্শ করে, যেমন দরজার হ্যান্ডেল, মোবাইল ফোন, টেবিল ইত্যাদি যেখানে ভাইরাসটি উপস্থিত। তারপর সেই হাত দিয়ে যদি চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করে, তাহলেও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
** ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ- একই ঘরে আক্রন্ত ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘ সময় অবস্থান করা, হাত মেলানো, আলিঙ্গন ইত্যাদির মাধ্যমে এই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। বিশেষ করে, যদি একজন ব্যক্তি সংক্রমিত হয় এবং অন্যজন সুরক্ষা না নেয়।
** বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমণ (Airborne Transmission)- বিশেষ কিছু পরিবেশে মাখ্যমে, যেমন poorly ventilated বা অপর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করে এমন ঘর, ভাইরাস বাতাসের সঙ্গে দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে এবং দূরবর্তী অন্য কোন ব্যক্তিকেও সংক্রমিত করতে পারে।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ কি কি?- What are the symptoms of the coronavirus?
করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির মধ্যে উপসর্গ দেখা দিতে সময় লাগতে পারে ২ দিন থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত। আবার কেউ কেউ সম্পূর্ণ উপসর্গ বিহীন থাকলেও, অন্যদের ক্ষেত্রে মৃদু আরম্ভ শুরু করে গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আর এই লক্ষণগুলোকে সাধারণত ৩ (তিন) টি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। নিচে লক্ষণগুলো সম্পর্কে দেখুন-
কোরনার প্রাথমিক/ সাধারণ লক্ষণ সমূহ- Early/Common Symptoms of Corona
- হাঁচি, সর্দি।
- গলা ব্যথা।
- মাথা ব্যথা।
- শুকনো কাশি।
- অবসাদ/ দুর্বলতা।
- মাংস পেশির ব্যথা।
- হালকা থেকে মাঝারি জ্বর।
- ঘ্রাণ ও স্বাদের অনুভূতি হারানো।
কোরনার মধ্যম লক্ষণ সমুহ- Moderate symptoms of corona
- বুক ব্যথা।
- বুক ধড়ফড় করা।
- অধিক ক্ষুধা ও ঘুমে ব্যাঘাত।
- হালকা পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়া।
কোরনার গুরুতর লক্ষণ সমুহ- Severe symptoms of corona
- বুকে অধিক ব্যথা অনুভব।
- ঠোঁট বা মুখ নীল হয়ে যাওয়া।
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা শ্বাসকষ্ট।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়া/ অতিরিক্ত দুর্বলতা।
- অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯০%-এর নিচে নেমে যাওয়া ইত্যাদি।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়- Home remedies for personal air
করোনা ভাইরাস বা রোগ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন এবং স্বাস্থ্যবিধি সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তবে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immunity) বাড়ানোর জন্য, কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। যা, আমাদের শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি যোগায় এবং সাহায্য করে। নিচে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে দেখুন-
আদা, মধু ও লেবুর চা- Ginger, honey and lemon tea
আদা ও লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও ভাইরাস প্রতিরোধকারী উপাদান। তাই, প্রতিদিন সকালে আদা ও লেবুর রস দিয়ে গরম চা খেলে, গলা পরিষ্কার করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
গরম পানির ভাপ নেয়া- Steaming hot water
কারো যদি নাক বন্ধ হওয়া, সাইনাস বা হালকা শ্বাসকষ্ট থাকে, তাহলে গরম পানির ভাপ নিলে খুব উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, এতে শ্বাসনালী পরিষ্কার হয় এবং ভাইরাস ধ্বংস করতে সহায়তা করে।
রসুনের রস খাওয়া- Drinking garlic juice
রসুনে পাওয়া যায় অ্যালিসিন নামক বিশেষ এক ধরণের অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান। যা, ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এরজন্য প্রতিদিন কাঁচা রসুন চিবিয়ে বা রস খাওয়ার অভ্যাস করুন।
হলুদ ও দুধ পান করা- Drinking turmeric and milk
হলুদে রয়েছে প্রচুর কারকিউমিন, যা এক ধরণের শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ভাইরাল উপাদান। তাই, প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম দুধে, এক চিমটি হলুদ মিশিয়ে পান করলে প্রচুর উপকার পাওয়া যায়।
আমলকি ও ভিটামিন সি- Amla and Vitamin C
আমলকি, লেবু, পেয়ারা ইত্যাদি ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার। যা, নিয়মিত খেলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম অনেক শক্তিশালী হয়। এতে করে শরীর সতেজ হয় এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে।
তাজা ফল ও শাকসবজি- Fresh fruits and vegetables
আমাদের প্রতিদিনের নিয়মিত খাদ্য তালিকায় ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া খুব দরকার। এরজন্য তাজা ফল, সবজি, বাদাম, দই ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত পানি পান- Drink enough water
প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করুন। কারণ, পানি শরীরের টক্সিন বের করতে সাহায্য করে এবং গলা ও শ্বাসনালিকে হাইড্রেটেড রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নিয়মিত ঘুমনো- sleep regularly
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা নিয়মিত ঘুমানো উচিত। কারণ, ঘুম কম হলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগ সহজে আক্রমণ করে। অপরদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম হলে শরীর সুস্থ থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
ধ্যান ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন- Meditation and mental health care
করোনা কালীন সময়ে মানসিক চাপ অনেক বাড়ে। আর নিয়মিতভাবে হাটাচলা করা, ধ্যান, যোগব্যায়াম এবং ইতিবাচক চিন্তা শরীর ও মনের জন্য অনেক উপকারী। তাই, এই সকল অভ্যাস গড়ে তুলুন।
পোশাক/ ঘর পরিষ্কার রাখা- Keeping clothes/house clean
নিয়মিতভাবে শরীর ও পোশাক এবং শোয়ার ঘর, রান্নাঘর, টয়লেট ইত্যাদি জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করুন। তাছাড়া, ঘরের জানালা খুলে রাখলে আলো-বাতাস ঢুকবে, যা ভাইরাস দমনে সাহায্য করে। তাই, ঘরে আলো বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করা উচিত।
স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা- Hygiene and preventive measures
করোনা ভাইরাস বা রোগ যাতে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য অবশ্যই আমাদের কিছু স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলা উচিত। তাই, আমাদের সকলের উচিত, নিচের স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা করা।
- মাস্ক পরিধান করুন।
- হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখুন।
- স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা গ্রহণে অনিচ্ছা পরিহার করুন।
- ভিড় এড়িয়ে চলুন এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন।
- বারবার সাবান দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুন।
- বাইরে থেকে আসার পরে ভালোভাবে হাত-মুখ ধুয়ে ফেলুন।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ঘরোয়া টিপস ও স্বাস্থ্যবিধি- শেষকথাঃ Home tips and hygiene rules to prevent coronavirus - final words
করোনাভাইরাস মানুষকে সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি এবং জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। যদিও, টিকা ও চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা অনেক নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। তবুও, করোনা ভাইরাস বা রোগকে কখনো হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আমরা যদি, নিয়মিতভাবে সঠিক তথ্য, স্বাস্থ্য সচেতনতা, ঘরোয়া প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যবিধির প্রতি গুরুত্ব দেই, তাহলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকটাই সহজ। তাই, নিজে সচেতন হোন, পরিবার ও সমাজকে সচেতন করুন।
আরো পড়ুনঃ সান্ডা কী? সান্ডা তেল, উপকারিতা, ব্যবহারবিধি ও ইসলামে অবস্থান
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিতকে শেয়ার করুন, তারাও যেন এটির মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url