হরমোন কি? হরমোনের সমস্যা কেন হয়?। ঘরোয়া উপায়ে হরমোন সমস্যা সমাধান

আরো পড়ুনঃ স্বাস্থ্য উপকারিতায় দেশীয় ফল । বিভিন্ন ফলের স্বাস্থ্য উপকারিতায় গুরুত্ব

হরমোন মানব শরীরের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। আর বর্তমান ব্যস্ততম জীবনজাত্রা, বিভিন্ন মানসিক চাপ এবং খাদ্যাভাসের কারণে, আমাদের মানব শরীরের হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে খুব সহজে।

হরমোনের সমস্যা দেখা দিতে পারে নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই, এতে করে দেখা দেয় বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, "হরমোন কী, হরমোনের সমস্যা কেন হয়, কী লক্ষণ দেখা যায় এবং ঘরোয়া উপায়ে কীভাবে হরমোনের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা যায়, ইত্যাদি বিসয় সম্পর্কে। চলুন তাহলে দেখি-

হরমোন কি?- What are hormones?

হরমোন হলো মানুষের শরীরের এন্ডোক্রাইন গ্রন্থি নিঃসৃত বিশেষ এক রাসায়নিক বার্তা বাহক, যা শরীরের রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে সংকেত পৌঁছে দেয় শরীরের বিভিন্ন বা পুরো শরীরের এবং এটি শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে।

হরমোনের কাজ কি?- What is the function of hormones?

হরমোন মানুষের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তার মধ্যে নিম্নে কয়েকটির নাম সম্পর্কে দেখুন। যেমন-

• শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশ নিয়ন্ত্রণ।
• ঘুম, আবেগ, স্ট্রেস ও মুড নিয়ন্ত্রণ।
• রক্তচাপ ও রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ।
• বিপাক প্রক্রিয়া (metabolism) সঞ্চালন।
• প্রজনন ক্ষমতা ও যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ

হরমোনের সমস্যা হয় কেন?- Why do hormonal problems occur?

মানুষের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ঘটে তখন, যে সময় শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ হরমোন তৈরি করতে না পারে বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ করে। নিম্নে হরমোনের সমস্যা হওয়ার কারণ সম্পর্কে দেখুন-

অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন

• ঘুম নিয়মিত না হওয়া।
• অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
• অপর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টি অভাব।
• অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত ও ফাস্টফুড খাওয়া।

গ্রন্থীর কার্যকারিতার সমস্যা

• অ্যাড্রিনাল ক্ল্যাণ্ড এবং পিটুইটারি ক্ল্যাণ্ডের অকার্যকারিতা।
• থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা যেমন হাইপো/হাইপার থাইরয়েডজেম।
• ডিম্বাশয়ের সমস্যা যেমন পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা PCOS।

বয়স ও শারীরিক পরিবর্তন

• বয়ঃসন্ধি।
• মেনোপেজের কারণে।
• গর্ভাবস্থা ও প্রসব পরবর্তী সময়ে।

বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

• স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ফলে।
• জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা ইনজেকশন।
• ওজন কমানোর জন্য নেওয়া ওষুধ।

পরিবেশগত দূষণের ফলে

• প্লাস্টিকজাত দ্রব্যে থাকা BPA এর ফলে।
• কীটনাশক ও রাসায়নিক বিষাক্ত পদার্থ ব্যবহার।

হরমোন ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ কি?- What are the symptoms of hormonal imbalance?

হরমোনের সমস্যার বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ রয়েছে, আর এই উপসর্গের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পায়। নিম্নে সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলো উল্লেখ করা হলো-

• ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি।
• চুল পড়া বা টাক পড়া।
• গর্ভ ধারণের সমস্যা হয়।
• যৌন আকর্ষণ কমে যাওয়া।
• ত্বকে অতিরিক্ত ব্রণ বা র‌্যাশ।
• ঘুম না হওয়া বা অতিরিক্ত ঘুম।
• শরীরে ক্লান্তিভাব ও শক্তির অভাব।
• অতিরিক্ত রাগ বা মানসিক অস্থিরতা
• অনিয়মিত মাসিক বা মাসিক বন্ধ হওয়া।

হরমোনের সমস্যা সমাধানের ঘরোয়া উপায়- Home remedies for hormonal problems

নিয়মিত ও স্বাভাবিক খাবার খাওয়ার পাশাপাশি সুস্থ্য জীবনযাপন এবং প্রাকৃতিক কিছু উপাদানের ব্যবহার এবং উপায় অনুসরণ করে হরমোনের অনেকটা ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। নিম্নে সবচেয়ে সহজ, জনপ্রিয় এবং কার্যকর ১০ ঘরোয়া পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

হরমোন সমস্যায়- তুলসি পাতার চা

তুলসী পাতায় রয়েছে কারটিসল নামক এক ধরণের স্ট্রেস, যা হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে এবং এনে দেয় মানসিক প্রশান্তি। এইজন্য প্রতিদিন তাজা তুলসি পাতা ৪/৫টি করে পানিতে ফুটিয়ে, দিনে ১/২ বার পান করুন।

হরমোন সমস্যায়- মেথি ভেজানো পানি

মেথি ভেজানো পানির ইনস্যুলিন হরমোন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, বিশেষ করে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারি। এই জন্য প্রতিদিন রাতে ১ টেবিল চামচ মেথি পা্নিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং সকালে খালিপেটে এই পানি পান করুন।

হরমোন সমস্যায়- আদা ও কাঁচা হলুদের চা

আদা ও কাঁচা হলুদের তৈরি চা শরীরের প্রদাহ কমাতে যেমন সাহায্য করে, তেমনিভাবে শরীরের হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। এর জন্য পরিমাণমত আদার টুকরো এবং কাচা হলুদ গরম পানিতে ফুটিয়ে নিয়মিত পান করুন।

হরমোন সমস্যায়- ফাইবারযুক্ত খাবার

হরমোন নিঃসরণে ফাইবারজুক্ত খাবার অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং উন্নত করে অন্ত্রের কার্যকারিতাকে। এর জন্য নিয়মিতভাবে ফাইবারযুক্ত খাবার যেমন, ওটস, শাকসবজি, ফলমূল, ব্রাউন রাইস, ডাল ইত্যাদি খাওয়া উচিত।

হরমোন সমস্যায়- ভিটামিন ডি গ্রহণ

থাইরয়েডসহ অন্যান্য হরমোনের কাজ সচল রাখতে ভিটামিন ডি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এরজন্য নিয়মিতভাবে সকাল থেকে দুপুর ১২ টার মধে সূর্যের আলোতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট হাঁটা হাটি করুন।

হরমোন সমস্যায়- ফ্লাক্স সিড/ তিসি বীজ

ইস্ট্রোজেন হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় ফ্লাক্স সিড/ তিসি বীজ অত্যান্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এর জন্য ফ্লাক্স সিড/ তিসি বীজ গুড়ো কর ওটস, স্মুদি, সালাদ বা দুধ মিশিয়ে নিয়মিত খেতে পারেন।

হরমোন সমস্যায়- অর্গানিক নারকেল তেল

অর্গানিক নারকেল তেল নিয়মিত ব্যবহার করলে থাইরয়েড ফাংশন সঠিক রাখার পাশাপাশি শরীরের হরমোন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে। এর জন্য প্রতিদিন অর্গানিক নারকেল তেল ১ টেবিল চামচ করে খালি পেটে বা রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন।

হরমোন সমস্যায়- যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন

প্রতিদিন নিয়মিতভাবে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করলে যেমন কর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোন কমায় তেমনিভাবে ঘুমের মান বাড়ায়। এরজন্য প্রতিদিন ৩০/৪০ মিনিট হাটাচলা করা, যোগব্যায়াম বা ধ্যানের অভ্যাস করা।

হরমোন সমস্যায়- চিনির ব্যবহার কমানো

ইনস্যুলিনসহ আরো অন্যান্য হরমোনের ব্যালেন্স সঠিক রাখার ক্ষেত্রে চিনির ব্যবহার কমানো অত্যান্ত জরুরি। এইজন্য আমাদের সকলের উচিত মিস্টি, সফট ড্রিঙ্কস এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।

হরমোন সমস্যায়- নিয়মিত ও গভীর ঘুম

মানুষের শরীরের প্রাক্রিতিক হরমোনের ব্যালেন্স নিঃসরণকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নিয়মিত ও গভীর ঘুম জরুরি। এরজন্য রাতে কমপক্ষে ৭/৮ ঘন্টা ঘুমান এবং ঘুমের আগে মোবাইল বা টিভি বন্ধ করে ঘুমালে ভালো হয়।

হরমোন সমস্যায় কখন ডাক্তা দেখাতে হবে?- When should you see a doctor for hormonal problems?

যদি হরমোনের উপরের লক্ষণগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং প্রাকৃতিক প্রতিকারগুলো কাজ না করে, সেক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব একজন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সেখানে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক হরমোন পরিস্থিতি জানা সম্ভব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ বা থেরাপি নির্ধারণ করা যায়।

হরমোন সমস্যা- শেষকথাঃ Hormonal problems - the final story

হরমোন আমাদের মানুষের শরীরে জন্য একটি সূক্ষ্ম অথচ এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, মানসিক চাপ ও দূষণের কারণে হরমোন ভারসাম্য যদি হারিয়ে যায়, তাহলে শরীরের নানা ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে। 

তবে, যদি খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ঘুম এবং কিছু ঘরোয়া ও প্রাকৃতিক উপায় অনুসরণ আমরা করি, তবে প্রাকৃতিকভাবে হরমোন নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখতে পারি। সকলে নিজে নিজের শরীরকে ভালোবাসুন, সচেতন থাকুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।

আরো পড়ুনঃ কাজু বাদাম- পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার সঠিক নিয়ম

আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিতি অন্যকে শেয়ার করুন, যাতে তারাও উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।