সান্ডা কী? সান্ডা তেল, উপকারিতা, ব্যবহারবিধি ও ইসলামে অবস্থান
আরো পড়ুনঃ কাজু বাদাম- পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, অপকারিতা ও খাওয়ার সঠিক নিয়ম
বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম একটি নাম "সান্ডা"। এটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভূটানসহ উপমহাদেশে প্রাচীন যুগ থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, বিভিন্ন ভেসজ ও প্রাণিজ উপাদান লোকজ চিকিৎসায়।
বহু প্রাচীন কাল থেকে জনপ্রিয় একটি নাম "সান্ডা"। বিশেষ করে এর তেলটি যৌন দুর্বলতার প্রতিকার হিসাবে জাদুকরি এক তেল নামে খ্যাতি লাভ করেছে। কিন্তু সান্ডা আসলে কি? এই তেল ব্যবহার কতটা নিরাপদ? ইসলামে এই তেলের অবস্থান কি? ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমরা জানবো আজকের আর্টিকেলে। চলুন দেখে নেওয়া যাক-
সান্ডা কি?- What is Sanda?
"সান্ডা" (Sanda) বলতে বুঝানো হয়ে থাকে, মরুভূমি অঞ্চলের নির্দিষ্ট একটি সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীকে, যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো Uromastyx। এই প্রাণিকে Spin-tailed lizadr বা বড় লেজ আছে এমন কাঁটাযুক্ত প্রাণিকে টিকটিকি নামেও ডাকা হয়।
এই সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীকে সাধারণত বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান ও আরবের মত উষ্ণ, শুস্ক এবং মরুভূমি অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই প্রাণিটি দেখতে আকারে ছোট, দেহ মোটা এবং লেজ ও কাটাযুক্ত হয়। অনেক এলাকায় স্থানীয় ভাষায় "সান্ডা", "সান্ধা", "সাণ্ডা" ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে।
সান্ডার তেল কি?- What is sandalwood oil?
সান্ডা নামের এই প্রাণীর চর্বি থেকে তৈরী হয় বিশেষ এক ধরণের মুল্যবান তেল, যা বহুল ব্যবহৃত হয় লোকজ চিকিৎসায়। এই তেলটি সাধারণত তৈরি করা হয়, আগুণে তাপ দিয়ে চর্বি গলিয়ে বা সিদ্ধ করে, তা বাজারজাত করা হয় এবং পরবর্তীতে এই তেলে বিভিন্ন ভেসজ উপাদান মেশানো হয়।
আর বিশেষ এই তেলকেই বাজারজাত করা হয় "সান্ডা তেল" নামে। এই তেলটি বিশেষভাবে ব্যবহার হয়, পুরুষের যৌন দুর্বলতা, দ্রুত বীর্যপাত, লিঙ্গের দৃঢ়টা, পেশির ব্যথা, বিভিন্ন বাত ইত্যাদি প্রতিকারে।
সান্ডার তেলের উপকারিতা?- Benefits of sandalwood oil?
সান্ডার তেল প্রধানত/ মূলত একটি আয়ুর্বেদিক পণ্য। এই তেল তৈরি হয়, সান্ডা নামের মরুভূমি অঞ্চলের সরীসৃপ গোত্রীয় প্রাণী থেকে। দীর্ঘদিন যাবত ভারত, পাকিস্তানে এটি আয়ুর্বেদিক পণ্য হিসাবে বিক্রয় হলেও, বাংলাদেশে এই তেলটি এসেছে বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর মাধ্যমে।
এই তেলটি মূলত ব্যবহার হয়ে থাকে, যে সকল পুরুষের যৌন সমস্যা, সেই সকল পুরুষের যৌন ক্ষমতা বাড়াতে, লিঙ্গের আকার বড় করতে, মিলনে স্থায়িত্ব বাড়াতে এবং যৌন দুর্বলতা দূর করতে। এছাড়া, এই তেল কি কি কাজে ব্যবহার করা হয়, তা নিম্নের আলোচনা থেকে দেখে নেওয়া যাক-
** যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে- সান্ডা তেল মূলত সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়, যৌন দুর্বলতা দূরীকরণে। অনেকের মতে, সান্ডার তেল লিঙ্গের রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে মিলনে স্থায়িত্ব বাড়ায়। বিশেষ করে যে সমস্ত ব্যাক্তিরা দ্রুত বীর্যপাত বা ইউরেকশের সমস্যায় ভোগেন, এটি হতে পারে কার্যকর, যা ইউনানী চিকিৎসায় দাবি করা হয়েছে।
** হাড় ও পেশির ব্যথায়- বাহ্যিক মালিশে সান্ডার তেল বহুকাল যাবত ব্যবহার করা হয়, জয়েন্টের ব্যথা, বাত, পেশীর খিচুনী ইত্যাদির সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রে। এতে রয়েছে, উষ্ণজাতীয় বৈশিষ্ট্য, যা শরীরের বিভিন্ন স্থানের রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং ব্যথা উপশমে সাহায্য করে।
** আর্থ্রাইটিস ও বাতের জন্য- আর্থ্রাইটিস বা গেটেবাতে আক্রান্ত রোগে যারা ভোগেন, সেই সকল রোগীরা এই তেল নিয়মিত ব্যথার ব্যবহারে/ মালিশ করলে উপশম হয় বলে, বিশ্বাস করা হয়। এই তেল হাড়ের শুস্কতা দূর করে নমনীয়তা ফিরিয়ে আনে হাড়ের সংযোগস্থলে।
** ত্বকের রোগে (লোকজ বিশ্বাসীদের মতে)- বিভিন্ন দেশের অনেক এলাকা আছে, যে সকল এলাকায় ব্যবহার করা হয়, ফুসকুড়ি বা চর্মরোগ, খোসপড়া ইত্যাদি চিকিৎসার কাজে। তবে, এর বিপরীতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ অনেকটাই সীমিত।
সান্ডার তেলের ব্যবহার পদ্ধতি- How to use sandalwood oil
সান্ডার চর্বি থেকে তৈরি তেল মূলত ব্যবহার করা হয়ে থাকে শরীরের বাহ্যিক স্থানে। নিম্নে সান্ডার তেলের ব্যবহার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
** লিঙ্গে মালিশ- সান্ডার তেল প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে লিঙ্গে হালকাভাবে মালিশ করতে হয়। তবে, তেল ব্যবহারের সময়, লিঙ্গে অতিতিক্ত চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। এটি নিয়মিতভাবে ১৫/২২ দিন ব্যবহার করলে অনেক উপকার পাওয়া যায় বলে, ব্যবহারকারীরা বলে থাকেন।
** বাত ও পেশীর ব্যথার জন্য- ব্যথার স্থানে তেলটি হালকা গরম করে মালিশ করুন। ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় মালিশ করেন। তবে, যদি, কোন প্রকারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে এটি ব্যবহার বন্ধ করুন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সান্ডা খাওয়ার নিয়ম ও বিশ্বাস- Rules and beliefs about eating sundae
অনেক এলাকা আছে, যেখানে সান্ডা নামের সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর মাংস বা চর্বি খাওয়া হয়। তারা, বিশ্বাস করেন যে, সান্ডা মানব দেহের শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি যৌনশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তবে, বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এটি খাওয়ার দাবির পক্ষে কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে পারেনি। সান্ডার চর্বি খাওয়ার জন্য নয়, মুলত এটির তেল শরীরের বাহ্যিক স্থানে ব্যবহারযোগ্য।
আরো পড়ুনঃ মাশরুমের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, নিরাপদ মাশরুম চেনার উপায় ও জনপ্রিয় রেসিপি
ইসলামের দৃষ্টিতে সান্ডা খাওয়া যায় কি?- Is it permissible to eat sanda according to Islam?
রাসূলে পাক (সাঃ)- এর হাদিস অনুযায়ী, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলে পাক (সাঃ)- এর সামনে সান্ডা পরিবেশন করা হলে, তিনি এটি খেতে অস্বীকৃতি জানান এবং বলেন, "এটি আমাদের এলাকার খাবার নয়"। (সহীহ বুখারী- ৫৪৮৪ এবং সহীহ মুসলিম- ১৯৪৪)
হাদিসটি বিশ্লেষণ-
- রাসূলে পাক (সাঃ) নিজে সান্ডা খাননি এবং কাউকে খেতে নিষেধও করেননি।
- সাহাবীগণেরা সান্ডা খেয়েছেন, এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
- তবে, হাদিস অনুযায়ী সান্ডাকে হারাম বলা যায় না।
বিভিন্ন মাযহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে সান্ডা- Sanda from the perspective of different madhhabs
সান্ডা খাওয়ার ব্যাপারে ইসলামের বিভিন্ন মাযহাবে বিভিন্ন মতাবাদ রয়েছে, নিম্নে এই সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
- হানাফি মাযহাব- অধিকাংশ আলেম একে মাকরুহ/অপছন্দনীয় খাবার।
- হাম্বলি মাযহাবে- জায়েজ, যদি তা থেকে কোনো ক্ষতি না হয়।
- মালিকি মাযহাবে- অনেক আলেম একে জায়েজ বলেন।
- শাফেঈ মাযহাবে- জায়েজ বলা হয়, হারাম নয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে সান্ডা তেল- Sandalwood oil in medicine
বরতমানে সান্ডা তেলের উপকারিতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা খুবই সীমিত। এখনো নিশ্চিতভাবে মেডিকেল সায়েন্স বলেনি, যে সান্ডা তেল যৌনশক্তি বা ব্যথা নিরাময়ে কার্যকর কিনা। সান্ডা তেলের উপকারিতা বেশিরভাগ, কেবলি লোকজ বিশ্বাস বা ইউনানী চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল।
সান্ডা তেল ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া- Side effects of using sanda oil
সকল জিনিসে কিছু কিছু পার্শ্বপ্ররিক্রিয়া রয়েছে, সেই ক্ষেত্রে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই এটি সঠিক ভাবে ব্যবহার না করলে নিম্নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন-
- এলারজি বা ফুসকুড়ি হতে পারে।
- বিভিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ ফোলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
- অতিরিক্ত উত্তেজনা, যা কিডনি বা হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
- সেকারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন ব্যবহার করা উচিত হবে না।
সান্ডা তেল কোথায় পাওয়া যায়?- Where can I find sanda oil?
বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে অনলাইনে এবং ইউনানী ওষুধের দোকানে সান্ডা তেল পাওয়া যায়। নিম্নে কয়েকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড সম্পর্কে দেখে নিন-
- Hamdard Sanda Oil
- Roohani Sanda Oil
- Herbal Sanda Oil
- Sanda King Oil
সান্ডা তেলের সারসংক্ষেপ- Summary of Sanda Oil
সান্ডা তেলের সারসংক্ষেপ |
||
ক্রঃ নং |
বিষয় |
তথ্য |
১ |
ইসলামে অবস্থান |
হারাম নয়, মাকরুহ/জায়েজ মতভেদ আছে |
২ |
উপকারিতা |
যৌন শক্তি, ব্যথা উপশম, রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি |
৩ |
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া |
ত্বকে সমস্যা, এলার্জি, অঙ্গপ্রতিক্রিয়া |
৪ |
ব্যবহারযোগ্য অংশ |
চর্বি থেকে প্রস্তুত তেল |
৫ |
বৈজ্ঞানিক ভিত্তি |
স্পষ্ট নয়, গবেষণা সীমিত |
৬ |
সান্ডা কী |
মরুভূমির সরীসৃপ প্রাণী |
৭ |
ব্যবহার পদ্ধতি |
বাহ্যিক মালিশ |
সান্ডা ও সান্ডা তেল- শেষকথাঃ Sanda and Sanda Oil - The Last Story
সান্ডা ও সান্ডা তেল দীর্ঘদিন যাবত লোকজ ও ইউনানী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও, এর উপকারিতা বেশ কিছু দাবি রয়েছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো অপর্যাপ্ত। তাছাড়া, ইসলামে এটি সম্পূর্ণ হারাম না হলেও, সতর্কতা অবলম্বন করাই হবে উত্তম।
এটি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার না করাই উচিত, বিশেষ করে যারা যৌন সমস্যায় ব্যবহার করবেন। বর্তমানে বাজারে প্রচুর নকল সান্ডা তেল পাওয়া যায়, যা আমাদের মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই, সবসময় বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড বা অনুমোদিত দোকান থেকে কিনুন।
আরো পড়ুনঃ কালোজিরার পুষ্টি উপাদান উপকারিতা ও অপকারিতা
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করুন, তারাও যেন উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন, এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url