ডিজিটাল বাংলাদেশ কী? সেবা, ইতিহাস, ফ্রিল্যান্সিং ও স্মার্ট ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা

আরো পড়ুনঃ কিভাবে AI দিয়ে আয় করা যায় । AI দিয়ে আয় করার জনপ্রিয় ১৫টি উপায়

"ডিজিটাল বাংলাদেশ" এখন কোন স্বপ্ন নয়, এটি আজকের দিনের বাস্তবতা। গত ২০০৮ সালে ঘোষিত এই রূপকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ছিল, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে, বাংলাদেশের প্রতিটি খাতকে আধুনিক ও জনবান্ধব করে গড়ে তোলা।

বর্তমানে আমরা এমন একটি সময়ে পৌঁছেছি, যেখানে ঘরে বসেই পাওয়া যায় নাগরিক সেবা, অনলাইন শিক্ষা, ই-কমার্স ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদি। তাছাড়া, ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি নির্ভরতায় গড়ে উঠছে নতুন এক সমাজব্যবস্থা, যা শুধুমাত্র সেবাই নয়, নাগরিকদের ক্ষমতায়নের পথও খুলে দিচ্ছে।

 “ডিজিটাল বাংলাদেশ” থেকে “স্মার্ট বাংলাদেশ”-এর দিক থেকে আমাদের যাত্রা এখন চলছে পুরোদমে, যার চালিকাশক্তি হবে ডিজিটাল লিটারেসি, উদ্ভাবন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। আজকের আর্টিকেলে আমরা জানব, ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাস, সেবা, ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। চলুন তাহলে আমরা দেখে নেই-

ডিজিটাল বাংলাদেশ কাকে বলে?- What is Digital Bangladesh?

ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্রীয় ধারণা, যেখানে তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সকল ধরণের সেবা যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সহজ কথায় বলা যায়, জীবনযাত্রার প্রতিটি বিষয়েই প্রযুক্তি-নির্ভর করে গড়ে তোলা হয়। 

এটি এমন এক ধরণের ভবিষ্যৎ, যেখানে মানুষ চাইলেই ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে, সরকারি ও বে-সরকারি সেবা গ্রহণ করতে সক্ষম হবে, ডিজিটাল দক্ষতার মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে এবং সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উন্নয়নে অংশ নিতে পারবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাস ও অর্জন- History and achievements of Digital Bangladesh

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর ধারণাটি প্রথম তুলে ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেই সময় লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক দেশ হিসাবে গড়ে তোলা। আর এই রূপকল্প ২০০৯ সাল থেকে বাস্তবায়নে শুরু হয় ব্যাপক কার্যক্রম। যেমন-

  • “এক দেশ, এক রেট” ইন্টারনেট সেবা।
  • ফ্রিল্যান্সিং ও আইসিটি স্কিল ডেভেলপমেন্ট।
  • ইউনিয়ন পর্যায়ে ৪৫০০+ ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন।
  • শিক্ষা ক্ষেত্রে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও অনলাইন শিক্ষা।
  • অনলাইনে সেবা গ্রহণের জন্য www.services.gov.bd চালু করণ।
  • নাগরিক সেবা ডিজিটালাইজ: পাসপোর্ট, জন্ম নিবন্ধন, ট্যাক্স ফাইলিং।
এইসব উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ফ্রিল্যান্সিং দেশগুলোর একটি হয়েছে এবং সরকার বর্তমানে অধিকাংশ সেবা অনলাইনের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে।

কিভাবে পাওয়া যায় ডিজিটাল সেবা?- How to get digital services?

বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশে ডিজিটাল সেবাগুলো পাওয়ার জন্য মূলত তিনটি মাধ্যমে রয়েছে। নিম্নে এই সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

  • জাতীয় পোর্টাল (www.bangladesh.gov.bd)- এখানে সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও জেলার নিজস্ব সেবার তালিকা রয়েছে।
  • একসেবা পোর্টাল (www.services.gov.bd)- এখানে প্রায় ২৭০ এর অধিক ডিজিটাল সেবা পাওয়া যায়, এরমধ্যে অন্যতম জন্ম নিবন্ধন, খতিয়ান, ট্রেড লাইসেন্স, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।
  • উপজেলা ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC)- সকল ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেবা নিতে চাইলে এই সেন্টারে গিয়ে সাহায্য পাওয়া যায়।
এছাড়াও, কিছু নির্দিষ্ট অ্যাপ রয়েছে, যেমন “Surokkha” (ভ্যাকসিন), “MyGov”, “Porichoy” (জাতীয় পরিচয় যাচাই), “Nothi” (ডিজিটাল অফিস) ব্যবহার করে ঘরে বসেই সকল ধরণের সেবা পাওয়া যায়।

কিভাবে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করবো?- How to register birth online?

কিছু নিয়ম অনুসরণ করার মাধ্যমে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করা যায় অনেক সহজেই। তাই, আপনি যদি অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করতে চান, তাহলে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে এগিয়ে চলুন। যেমন-

  • প্রথমে https://bdris.gov.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।
  • এখন “নতুন নিবন্ধন” অপশনটি বেছে নিন।
  • এখানে ব্যক্তিগত তথ্য দিন, যেমন নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম তারিখ, বিস্তারিত ঠিকানা।
  • এবার প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করুন, যেমন স্কুল সার্টিফিকেট, হাসপাতালের জন্ম সনদ ইত্যাদি।
  • আপনার আবেদনটি সাবমিট করুন।
  • আপনার আবেদন স্ট্যাটাস দেখতে চাইলে, দেখতে পারবেন পোর্টালে লগইন করার মাধ্যমে।
  • সত্যায়নের করা হয়ে গেলে, আপনার জন্ম সনদ অনলাইনের মাধ্যমে ডাউনলোড করতে পারবেন বা নির্দিষ্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।

কিভাবে অনলাইনে সরকারি ফরম পূরণ করবো?- How to fill government forms online

আপনার কাছে যদি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ডিজিটাল ডিভাইজ বা স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, তাহলে আপনি খুব সহজেই নিম্নের ধাপগুলো অনুসরণ করে সকল ধরণের সরকারি বা বে-সরকারি আবেদন ফরম অনলাইনে পূরণ করতে পারবেন। যেমন-

  • সরকারি ওয়েবসাইটে যেমন, https://forms.gov.bd প্রবেশ করুন। 
  • আপনি যেখানে আবেদন করবেন সেই ফর্মটি খুঁজে বের করুন।
  • এবার অনলাইনে ফর্ম পূরণ করুন অথবা ডাউনলোড করে হাতে পূরণ করুন।
  • সাবমিট করুন এবং রেফারেন্স নম্বর সংরক্ষণ করুন।
  • আবার অনেক সেবার খাত রয়েছে, যা “MyGov” অ্যাপ এর মাধ্যমে সরাসরি ফর্ম পূরণ ও সাবমিশন করার ব্যবস্থা রয়েছে বা করা যায়।

ফ্রিল্যান্সিং শেখা ও কাজ পাওয়ার উপায় কি- What are the ways to learn freelancing and get work?

ফ্রিল্যান্সিং শিখে কাজ শুরু করতে হলে, আপনাকে অবশ্যই নির্দিষ্ট একটি নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। তবে, অপনি যদি ফ্রিল্যান্সিং শিখতে চান, তাহলে নিম্নের ধাপগুলো অনুসরণ করলে সবচেয়ে ভালো হয়। এরজন্য প্রথমে আপনি আপনার পছন্দ বা আপনি যে বিষয় সম্পর্কে পারদর্শী সে বিষয়টি বেচে নিন। যেমন-

  • ভিডিও এডিটিং।
  • কনটেন্ট রাইটিং।
  • গ্রাফিক ডিজাইন।
  • ডিজিটাল মার্কেটিং।
  • ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট।
  • SEO, SMM ইত্যাদি।

ফ্রিল্যান্সিং শিখার নির্ভর প্লাটফর্ম

ফ্রিল্যান্সিং শিখার জন্য যদিও অনেক প্লাটফর্ম রয়েছে, তবে সকল প্লাটফর্ম নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ, অনেক প্লাটফর্ম রয়েছে, যেগুলো মানুষকে ধোকা দেয়। তবে, নিম্নের প্লাটফর্মগুলো অনেক জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য। যেমন-

  • Coursera, Udemy, YouTube (ফ্রি ও পেইড কোর্স)।
  • Google Skillshop, Meta Blueprint – ফ্রি মার্কেটিং কোর্স।
  • ICT Division এর 'Learning & Earning' প্রজেক্ট- https://ledp.gov.bd।

প্র্যাকটিস ও পোর্টফোলিও তৈরি

ফ্রিল্যান্সিং শিখা শেষ হলেই আপনি সঙ্গে সঙ্গে কাজ পাবেন এমন নাও হতে পারে। তাই, আপনকে নিয়মিতভাবে প্র্যাকটিস করতে হবে ও পোর্টফোলিও তৈরি করতে হবে।

মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খুলুন

ফ্রিল্যান্সিং শিখা শেষ কাজ পাওয়ার জন্য আপনাকে নিয়মিতভাবে প্র্যাকটিস করতে হবে এবং পোর্টফোলিও তৈরি তৈরির পাশাপাশি, যে সকল জনপ্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য মার্কেটপ্লেস রয়েছে সেগুলোতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। নির্ভরযোগ্য মার্কেটপ্লেসগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- 

  • Fiverr,
  • Upwork, 
  • Freelancer ইত্যাদি।

ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ ও ধৈর্য ধরুন

ফ্রিল্যান্সিং শিখা ও মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট খোলা শেষ হয়ে গেলে কাজ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন প্লাটফর্মের মাধ্যমে ক্লায়েন্টের সাথে ধৈর্যসহকারে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ কী?- What is Smart Bangladesh?

স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে বুঝানো হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী ধাপ, যার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উদ্ভাবনী, টেকসই, জ্ঞাননির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাকে। এটি মূলত ৪টি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হবে। যেমন-

  • স্মার্ট সরকার- ই-গভর্নেন্স, ওপেন ডেটা, স্বচ্ছতা।
  • স্মার্ট অর্থনীতি- স্টার্টআপ, ই-কমার্স, ব্লকচেইন, ফিনটেক।
  • স্মার্ট সমাজ- পরিবেশ সচেতনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ডিজিটালাইজেশন।
  • স্মার্ট নাগরিক তৈরি- ডিজিটাল লিটারেসি, উদ্ভাবনী চিন্তা ও উদ্যোক্তা হওয়া।
এই রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার ৫জি, AI, মেশিন লার্নিং এবং ব্লকচেইনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে।

২০২৫ সালের ই-গভর্নেন্সের সুবিধা কি?- What are the benefits of e-governance in 2025?

২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্সের মাধ্যমে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যাবে বা যাচ্ছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-

  • একটি আইডি মাধ্যমে সব সরকারি সেবা- ‘ডিজিটাল পরিচয়’ (Porichoy) দিয়ে সব পোর্টালে সেবা গ্রহণ করা যাবে।
  • ই-নথি- এর মাধ্যমে সকল সরকারি অফিসগুলো কাগজবিহীন হবে।
  • দ্রুত সেবাপ্রাপ্তি- জমির রেকর্ড, ট্যাক্স, লাইসেন্স, ট্রেড সেবা অনলাইনে ২৪ ঘণ্টা পাওয়া যাবে।
  • স্মার্ট অভিযোগ নিষ্পত্তি- এক ক্লিকের মাধ্যমে নাগরিকের যে কোন অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধান করা যাবে।
  • ডিজিটাল স্বাক্ষর (e-signature)- সরকারি চুক্তি ও কাগযে ডিজিটালভাবে সই করা যাবে।
  • প্রযুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ- ডেটা অ্যানালিটিক্স ও AI ব্যবহার করে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহন।

ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের পথে- শেষকথাঃ  On the path from Digital Bangladesh to Smart Bangladesh - Final words:

ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন কোন একটি রাজনৈতিক দলের স্লোগান নয়—এটি বাস্তবতা। বর্তমানে প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের মানুষ সকল ধরণের সেবা পাচ্ছে খুব সহজে ও দ্রুতগতিতে। ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন শিক্ষা, ই-কমার্স ও ই-গভর্নেন্স প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনমানকে আরো উন্নত করছে। 

স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে অগ্রসরের এই যাত্রা পথে প্রযুক্তিই হবে, ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি। আর এতে তরুণ প্রজন্ম যদি, এই সুযোগকে কাজে লাগায়, তবে সত্যিকার অর্থেই আগামিতে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে, একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশ।

আরো পড়ুনঃ ডিজিটাল যুগে তথ্য প্রযুক্তির প্রভাব ও ভবিষ্যৎ বাস্তবতা

আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালোলাগে এবং উপকারি বলে আপনি মনে করেন, তাহলে এটি আপনার পরিচিতদের শেয়ার করবেন, যাতে তারাও যেন এর মাধ্যমে উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url