গর্ভাবস্থায় কী খাবেন আর কী খাবেন না – গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার জন্য পরিপূর্ণ গাইড

একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় "গর্ভাবস্থা"। কারণ, এই সময়টি সংবেদনশীল সময়, যখন তার প্রতিটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত, ভবিষ্যতের অনাগত সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

সে কারণে, এই সময়ে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। কেননা, এটি শুধু মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করে না, বরং তার গর্ভস্থ শিশুর স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি ও বিকাশেও প্রভাব বিস্তার করে। তাই, পুষ্টিকর খাবার যেমন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ফলিক অ্যাসিড জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে নানা জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

অপরদিকে এমন অনেক খাবার খাবার আছে, যেগুলো খাবার অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত। আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আরটিকেলে আমরা জানবো, গর্ভাবস্থায় কি খাবেন ও কি খাবেন না এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তথ্য। চলুন তাহলে আমরা দেখে নেই-

গর্ভাবস্থায় কি খাবেন আর কি খাবেন না- What to eat and what not to eat during pregnancy

গর্ভাবস্থায় মা- বোনদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস তাঁদের ভ্রূণের সুস্থতা বৃদ্ধিসহ নিজের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই, এই সময়ে আয়রন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ফলিক অ্যাসিড এবং আঁশযুক্ত খাবার বেশি বেশি করে খাওয়া উচিত। পাশাপাশি প্রচুর পানি পান করাও জরুরি। 

অপরদিকে তাঁদেরকে কাঁচা বা আধা-সিদ্ধ খাবার, অতিরিক্ত ক্যাফেইন, মদ্যপান ও ধূমপান জাতীয় খাবার একেবারে এড়িয়ে চলা উচিত। তাই, সঠিক খাদ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গর্ভকালীন জটিলতা যেমন কমে, তেমনিভাবে একটি সুস্থ সন্তানের জন্মের সম্ভাবনাও বাড়ে।

গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব কি?- What is the importance of nutritious food during pregnancy?

গর্ভাবস্থায় সকল নারীর শরীরের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। কারণ, তখন মায়ের শরীরে দুটি প্রাণের জন্য কাজ করছে। তাই, এই সময় যদি, সঠিক খাদ্য গ্রহণ না করেন, তাহলে মা ও শিশু- উভয়েই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। পুষ্টিকর খাবার ভ্রূণের মস্তিষ্ক গঠনে, হাড়ের বৃদ্ধিতে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে সাহায্য করে।

আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খান- Eat foods rich in iron and folic acid.

গর্ভাবস্থায় তাঁদের রক্তের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, তাই প্রয়োজনও বেড়ে যায় আয়রনের। একই সাথে ফলিক অ্যাসিড নবজাতকের জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি রোধে সহায়তা করে। এই সময় নিম্নের খাবার খাওয়া জরুরী। যেমন-

  • পালং শাক, কলা, ডাল, লাল মাংস, ডিমের কুসুম ইত্যাদি।
  • ফলিক অ্যাসিডযুক্ত সাপ্লিমেন্ট যা, চিকিৎসকের পরামর্শে মতে।

ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার- Foods rich in calcium and vitamin D

গর্ভের শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠনকে মজবুত করার জন্য, ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন পড়ে। আর ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। এই জন্য যে খাবার খাওয়া প্রয়োজন-

  • দুধ, দই ও পনির জাতীয় খাবার।
  • ডিম, সামুদ্রিক মাছ (যেমন স্যামন), সূর্যালোক।

প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরি- It is important to eat protein-rich foods.

প্রোটিন মানুষের শরীরের কোষ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ দেহ গঠন ও বিকাশে সহায়তা করে থাকে। তাই, গর্ভাবস্থায় তাঁদের প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এইজন্য নিম্নের খাবার খাওয়া যেতে পারে। যেমন-

  • ডিম, মুরগির মাংস (চিকেন), মাছ।
  • ডাল, সয়াবিন, বাদাম ইত্যাদি।

কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে আঁশযুক্ত খাবার খান- Eat fiber-rich foods to prevent constipation.

গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্য একটি অতি সাধারণ সমস্যা, যা আঁশযুক্ত খাবার নিয়মিত খেলে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এইজন্য শাক-সবজি, ফল ও Whole grain খাবারের পাশাপাশি নিম্নের আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। যেমন-

আরো পড়ুনঃ গরমে সুস্থ থাকার ১০টি ঘরোয়া উপায় – হিটস্ট্রোক ও পানিশূন্যতা থেকে বাঁচার উপায়

  • ওটস, ব্রাউন রাইস, শাকসবজি।
  • ফল যেমন আপেল, পেয়ার, আমড়া।

পর্যাপ্ত পানি পান করুন- Drink enough water

গর্ভাবস্থায় হাইড্রেশন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শরীরে পানির অভাব দেখা দিলে মাথা ঘোরা, প্রস্রাবে জ্বালা- পোড়া, দুর্বলতা ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই প্রচুর পানি পান করুন। যেমন-

  • প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
  • ডাবের পানি ও ফলের রস ইত্যাদি খাবার।

অ্যালকোহল ও ধূমপান সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলুন- Avoid alcohol and smoking completely.

অ্যালকোহল ও ধূমপান গর্ভস্থ শিশুর জন্য অত্যান্ত/ মারাত্মক ক্ষতিকর। তাছাড়া, এতে শিশুর জন্মগত সমস্যা, মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশুর জন্ম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যা এড়িয়ে চলতে হবে-

  • মদ্যপান এবং সিগারেট।
  • সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোক বা ধূমপায়ী পরিবেশ এড়িয়ে চলা।

অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করবেন না- Don't consume excess caffeine.

গর্ভাবস্থায় তাঁরা যদি অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ করেন, তাহলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে এমনকি শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিতেও ব্যাঘাত ঘটে। ফলে, শিশুর কম ওজনে জন্ম হওয়া অথবা সময়ের আগেই প্রসব হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই যা সীমিত রাখতে হবে-

  • চা, কফি, কোলাডিংক জাতীয় পানীয়।
  • দিনে সর্বোচ্চ ২০০ মি.গ্রা. অধিক ক্যাফেইন (১ কাপ কফি্র বেশি)।

কাঁচা ও অপরিষ্কৃত খাবার থেকে বিরত থাকুন- Avoid raw and unprocessed foods.

কাঁচা বা আধা সিদ্ধ খাবারে থাকতে পারে লিস্টেরিয়া বা স্যালমোনেলার মতো ব্যাকটেরিয়া, যা গর্ভবতী মা- বোন ও ভ্রূণের জন্য মারাত্মক সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই যে খাবার বর্জনযোগ্য-

  • অর্ধসিদ্ধ মাংস বা মাছ।
  • কাঁচা ডিম, সুশি, অপরিচ্ছন্ন ফল।

বেশি লবণ ও চিনি এড়িয়ে চলুন- Avoid excess salt and sugar.

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপ, পানি ধরে রাখা (water retention) এবং প্রি-এক্ল্যামসিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। অপরদিকে গর্ভকালীন সময়ে বেশি চিনি খেলে ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন ও শিশুর স্থূলতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই পরিমিত লবণ ও চিনি গ্রহণ জরুরি। যেমন-

  • কম লবণযুক্ত খাবার খান।
  • মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খান।

গর্ভকালীন ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট – কখন খাবেন?- Pregnancy vitamins and supplements – when to take them

গর্ভাবস্থায় সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ মতে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা জরুরি। সাধারণত, প্রয়োজন হয় ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট, যা মা ও গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। এবিষয়ে নিচে দেখুন-

  • প্রথম তিন মাস ফলিক অ্যাসিড অত্যাবশ্যক।
  • ৪র্থ মাস থেকে আয়রন ও ক্যালসিয়াম।
  • ভিটামিন ডি এবং বি১২ রক্ত পরীক্ষার ভিত্তিতে।

খাবারে ব্যালেন্স বজায় রাখুন- Maintain a balance in your diet.

গর্ভাবস্থায় প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গর্ভবতীকে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার রাখা জরুরি। এই ব্যালান্সড ডায়েটকে যেমন গর্ভকালীন স্বাস্থ্য রক্ষা করে তেমনি অতিরিক্ত ওজন বাড়া বা কমে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এরজন্য নিম্নের তালিকা অনুযায়ী খাবার খেতে হবে। যেমন- 

  • সকালের নাস্তায় দুধ, ওটস, একটি ফল।
  • দুপুরে ভাত, ডাল, মাছ/ মুরগি, শাক।
  • বিকেলের নাস্তা বাদাম, মৌসুৌসুমি।
  • রাতের খাবার রুটি, সবজি ও ডিম।

গর্ভাবস্থায় যা করতে হবে- শেষকথাঃ Things to do during pregnancy - final words

গর্ভাবস্থা যে কোন মা- বোনদের জন্য খুবই একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। যেখানে মায়ের খাদ্যাভ্যাসের উপর তাঁদের অনাগত সন্তানের সুস্বাস্থ্যের ভিত্তি স্থাপন করে। তাই এই সময়, সঠিক পুষ্টির পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক প্রশান্তি ও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য।

কোন কারণে গর্ভাবস্থা যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয় বা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ গাইনী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যতালিকা গ্রহণ করুন। কারণ, এটি মা ও শিশুর সুস্থতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

আরো পড়ুনঃ করোনা ভাইরাস- লক্ষণ, সংক্রমণ ও প্রতিরোধে ঘরোয়া উপায়

পাঠকের জন্য পরামর্শ- Advice to the reader

আজকের এই আর্টিকেলটি যদি, আপনার ভালোলাগে ও উপকারে আসে, তাহলে অবশ্যই (দয়া করে) আপনার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করুন। সবার জন্য সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করি। সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন। আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যাবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url