গরমে সুস্থ থাকার ১০টি ঘরোয়া উপায় – হিটস্ট্রোক ও পানিশূন্যতা থেকে বাঁচার উপায়
আরো পড়ুনঃ করোনা ভাইরাস- লক্ষণ, সংক্রমণ ও প্রতিরোধে ঘরোয়া উপায়
গ্রীষ্মকালে আমাদের বাংলাদেশে তাপমাত্রা প্রায় সময় ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠা- নামা করে। আর এই অতিরিক্ত গরমের কারণে আমদের ক্লান্তি, পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোক, চামড়ার রোগ ও খাদ্যজনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়।
তাই, গরমে আমাদের নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য, প্রয়োজন পড়ে কিছু বাড়তি ও সহজ, কিন্তু কার্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা। আমরা আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করবো, গরমে সুস্থ থাকার ১০টি বাস্তবসম্মত ও প্রমাণিত উপায় সম্পর্কে, যেগুলো অনুসরণ করলে আপনি ও আপনার পরিবার এই গরমেও সুস্থ, সতেজ ও প্রফুল্ল মনে থাকতে পারবেন।
গ্রীষ্মকালের তাপদাহ - বাংলাদেশে গরমের বাস্তব চিত্র- Summer Heat - The Real Picture of Summer Heat in Bangladesh
গ্রীষ্মকাল এলেই আমাদের এই বাংলাদেশ যেন রোদের আগুনে পুড়ে যায়। সকাল গড়াতেই চারপাশে শুরু হয় হাঁসফাঁস; শুকিয়ে যাওয়া গাছপালা, তপ্ত বাতাস, আর দুপুরবেলার রোদের তাপে রাস্তাও যেন জ্বলতে থাকে।
এ সময়টায় ঘরে-বাইরে সবাইকে লড়তে হয় অতিরিক্ত গরম, ক্লান্তি ও পানিশূন্যতার মতো বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে। তাই, এই গরমে সুস্থ ও সতেজ থাকতে হলে আমাদের নিতে হয় কিছু সচেতন সিদ্ধান্ত ও অভ্যা্স, যা আমরা নিচের আলোচনা থেকে জানবো। চলুন নিচে দেখি-
প্রচুর পানি পান করা – হাইড্রেটেড থাকাই মূল চাবিকাঠি- Drink plenty of water – staying hydrated is key.
গরমে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরায়, যারফলে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি ও লবণ দ্রুত বের হয়ে যায়। আর এই ঘাটতি যদি পূরণ না করা হয়, তাহলে শরীর ডিহাইড্রেশন, মাথা ঘোরা ও হিটস্ট্রোকের মত সমস্যা হতে পারে।
গরমে কি করবেন?- What to do in the heat?
- প্রতিদিন অন্তত ৮ থেকে ১০ গ্লাস পানি পান করুন।
- শরবত, ডাবের পানি, লেবু পানি, ওরস্যালাইন পান করুন।
- চা–কফি ও কোল্ড ড্রিংকস কমিয়ে দিন, এগুলো ডিহাইড্রেশন বাড়ায়।
ফল ও শাকসবজি খান – শরীরকে ভেতর থেকে ঠাণ্ডা রাখুন- Eat fruits and vegetables – keep the body cool from the inside out
গ্রীষ্মকালে অনেক মৌসুমি ফল ও সবজি পাওয়া যায়, যা আমাদের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল যোগাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যে সকল ফলে পানি বেশি পাওয়া যায়, সেগুলো গরমে খুবই উপকারী।
কোন কোন খাবার খাবেন?- What food will you eat?
- টমেটো, লাউ, পুঁই শাক, ঢেঁড়স ইত্যাদি সবজি।
- তরমুজ, বাঙ্গি, ডাব, কমলা, শসা, পেঁপে, আনারস।
- প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তত ৩–৪ প্রকার সবজি রাখুন।
হালকা ও ঢিলেঢালা পোশাক পরুন – শরীরকে শ্বাস নিতে দিন- Wear light and loose clothing – let your body breathe
গরমের সময় সিন্থেটিক ও টাইট কাপড় আমাদের ত্বকের সঙ্গে লেগে থাকে, যা ঘাম আটকে রাখে, ফলে ত্বক সঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। এরফলে ঘামাচি, চুলকানি ও ফুসকুড়ির মত সমস্যা বেড়ে যায়। তাই, গরমের এই সময়ে ঢিলেঢালা ও সুতি কাপড় পরাই উত্তম।
কী ধরনের পোশাক পরবেন- What kind of clothes to wear?
- সুতির কাপড় ও হালকা রঙের জামা।
- ঢিলেঢালা এবং বাতাস চলাচলযোগ্য পোশাক।
- বাইরে গেলে মাথা ঢাকার জন্য হ্যাট বা স্কার্ফ ব্যবহার করুন।
ত্বকের যত্ন নিন – ঘাম ও রোদ থেকে বাঁচুন- Take care of your skin – avoid sweat and sun.
গরমের সময় অতিরিক্ত ঘাম, ধুলাবালি ও রোদের কারণে ত্বক দ্রুত মলিন ও রুক্ষ হয়ে যায়। ফলে ত্বকে দেখা দেয় ব্রণ, চুলকানি যা, ত্বকে জ্বালাপোড়ার সমস্যাকে বাড়ায়। তাই এই সময় আমাদের নিয়মিত পরিষ্কার, ময়েশ্চারাইজ ও সানস্ক্রিন ব্যবহারের মাধ্যমে ত্বকের যত্ন নেয়া খুবই জরুরি।
কি কি করতে হবে?- What to do?
- প্রতিদিন অন্তত ২ থেকে ৩ বার মুখ ধুয়ে নিন।
- ঘরের বাহিরে বা রোদে যাওয়ার আগে অবশ্যই সানস্ক্রিন লাগান।
- ত্বকে ঘাম বা চিটচিটে ভাব এড়াতে ফেস পাউডার বা বেবি পাউডার ব্যবহার করুন।
পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম – গরমে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়- Get enough sleep and rest – the body gets tired quickly in the heat.
উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ফলে আমাদের শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং শরীরের শক্তি হ্রাস পায়। তাই, গরমের এই সময়ে পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম না নিলে শরীরে দেখা দিতে পারে দুর্বলতা, মাথাব্যথা ও ঝিমঝিম ভাব। সে কারণে, নিয়মিত বিশ্রাম অত্যন্ত প্রয়োজন।
ঘুম ও বিশ্রামের জন্য পরামর্শ- Advice for sleep and rest
- প্রতিদিন নিয়মিতভাবে অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমান।
- ঘুমানোর ঘরে ফ্যান বা বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।
- গরমে দুপুরে ২০–৩০ মিনিট বিশ্রাম নিন (পাওয়ার ন্যাপ)।
হালকা ও পরিমিত খাবার খান – গরমে বেশি ভারী খাবার বিপজ্জনক- Eat light and moderate meals – eating too much heavy food in the heat is dangerous.
গরমে পচনশীল খাবার অতিদ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, সেটি খেলে খাদ্যে বিষক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে, পাশাপাশি ভারী ও তেল-ঝাল জাতীয় খাবার হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই, গরমের সময় হালকা, সহজপাচ্য এবং টাটকা খাবার খাওয়া শরীরের জন্য অনেক উপযোগী ও নিরাপদ।
গরমে যে খাবার খাবেন?- What food do you eat in summer?
- ভাত, ডাল, সবজি – হালকা ও পরিপাকযোগ্য খাবার।
- কম তেল–মসলা ও অতিরিক্ত মাংস–ঝাল বাদ।
- বাইরের রাস্তার খাবারকে এড়িয়ে চলুন।
দুপুরের (১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত) রোদ এড়িয়ে চলুন- Avoid the midday sun (12pm to 4pm).
গ্রীষ্মকালে সূর্য প্রচণ্ড তাপ ছড়িয়ে পড়ে, যা শরীরের তাপমাত্রাকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে তোলে। তাই, দীর্ঘ সময় রোদে থাকলে শরীরে পানিশূন্যতার পাশাপাশি তাপ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়। ফলে, হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। তাই, রোদে বিশেষ করে দুপুরে বাইরে গেলে সুরক্ষা নেয়া জরুরি।
দুপুরে কি করবেন?- What to do in the afternoon?
- অতিরিক্ত প্রয়োজন ছাড়া এই সময়ে বাইরে যাবেন না।
- গেলে ছাতা, সানগ্লাস, টুপি এবং পানির বোতল সঙ্গে রাখুন।
- বাসায় থাকা অবস্থায় জানালা দিয়ে বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখুন।
সকাল - সন্ধ্যায় ব্যায়াম করুন – শরীরকে ফিট রাখুন- Exercise in the morning and evening - keep your body fit
গরমে শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করলে শরীর প্রচুর ঘামে, ফলে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে। তবে, ভোর/সকাল - সন্ধ্যায় সঠিক সময়ে হালকা ব্যায়াম করলে, শরীর ফিট থাকে, রক্ত সঞ্চালন ভালো হয় এবং তাপজনিত অসুস্থতাকে অনেকটা দূরে রাখা যায়।
ব্যায়াম সময় ও ধরন কি?- What is the exercise time and type?
- ভোরে/ সকাল -সন্ধ্যায় হালকা হাঁটা, যোগব্যায়াম, মেডিটেশন করা।
- গরমে দৌড় বা হাই-ইনটেনসিটি ওয়ার্কআউট কমানো ভালো।
- বাইরে এক্সারসাইজ করলে ছায়াযুক্ত জায়গা বেছে নিন।
ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করুন – শরীরকে রিফ্রেশ রাখুন- Take a cold shower – keep your body refreshed.
গরমে দিনে অন্তত ১ থেকে ২ বার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে, শরীরের অতিরিক্ত উত্তাপ কমে এবং শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাছাড়া, এটি ঘাম, ক্লান্তি ও জ্বালাপোড়া দূর করে শরীর ও মনের সতেজতাকে বাড়িয়ে তোলে। গ্রীষ্মে সুস্থ থাকতে এই অভ্যাসগুলো খুবই উপকারী।
ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসলের উপকারিতা কি?- What are the benefits of bathing with cold water?
- ঘাম ও ধুলাবালি দূর হয়।
- ঘুম ভালো হয় ও ক্লান্তি দূর হয়।
- শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বাড়তি সতর্কতা- Extra precautions for children and the elderly
গরমে শিশু/বাচ্চা, প্রবীণ ও অসুস্থ ব্যক্তিদের শরীর অধিক তাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে অতিরিক্ত গরমে তারা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাই, তাদের পর্যাপ্ত পানি পান করানো, হালকা পোশাক পরানো ও ঠাণ্ডা পরিবেশে রাখা খুব জরুরি। কেননা বিশেষ যত্নে তাদের সুস্থ রাখা সম্ভব।
গরমে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য করণীয় কি?- What to do for children and the elderly in the summer?
- শিশুদের বেশি করে পানি পান করান।
- ঘামের কাপড় অতিদ্রুত পাল্টে দিন।
- শিশু- বৃদ্ধদের ঠাণ্ডা পরিবেশে রাখা।
- নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া
গরমে যা করতে ভুলবেন না- Things you shouldn't forget to do in summer
গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত গরমের ফলে আমাদের শরীরকে সুস্থ্য রাখার জন্য, অবশ্যই নিম্নের কাজগুলো করতে হবে। যেমন-
- বাহির থেকে এসে হাত–মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।
- ঠাণ্ডা জিনিস অতিরিক্ত খাবেন না – ঠান্ডা লাগার ভয় থাকে।
- রোদে গেলে গরম গায়ে ঠাণ্ডা পানি না ঢালুন – ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হোন।
- ঘরে, ঘরের জানালা খুলে রাখুন – যাতে বাতাস চলাচল করে।
- ওরস্যালাইন পাউডার ঘরে মজুদ রাখুন – জরুরি সময়ে কাজে লাগবে।
গরমে যা করবেন - যা করবেন না- শেষকথাঃ What to do and what not to do in summer - final words
গ্রীষ্মকাল আমাদের বাংলাদেশীদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই মৌসুম যেমন ফসলের সময়, তেমনিভাবে কিছুটা কষ্টেরও সময় এটি। তবে, যদি আমরা সচেতনতা অবলম্বন করার পাশাপাশি কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তুলি – তাহলে, গরমকেও আর আমাদের ভয়ের কিছু মনে হবে না।
নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া, খাদ্যাভ্যাস, ঘুম এবং গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে পালন করি, তাহলে এই গরমের কালেও আপনি ও আপনার পরিবার থাকতে পারবেন শারীরিকভাবে সুস্থ, সতেজ ও প্রফুল্ল।
আরো পড়ুনঃ স্বাস্থ্য উপকারিতায় দেশীয় ফল । বিভিন্ন ফলের স্বাস্থ্য উপকারিতায় গুরুত্ব
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের কাছে ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিতদের শেয়ার করুন, তারাও যেন এর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url