কুমিল্লার প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যে । কুমিল্লা সেরা ও জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের তীর্থভূমি কুমিল্লা লেলা। খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের জন্য বাংলাদেশে বিখ্যাত কুমিল্লা জেলা, যা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত অন্যতম গুরুতবপূরণ একটি জেলা।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরা কুমিল্লা জেলা
শিল্প , শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ভরপূর প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ কুমিল্লা জেলাটি প্রাচীনকালে সমতট জনপদের অন্তর্গত ছিল এবং পরবর্তী সময়ে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। কুমিল্লা এলাকা প্রাচীন সমতট রাজ্যের অংশ ছিল।এই অঞ্চলটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে অবস্থিত ময়নামতি ও কোটবাড়িতে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, এই অঞ্চলের সমৃদ্ধের ইতিহাসের অন্যতন প্রমাণ। ১৩ শতকের শেষভাগে ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে যায় এবং ত্রিপুরা রাজ্য এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। ত্রিপুরা রাজারা তাদের রাজধানী ময়নামতিতে স্থাপন করেন।
ত্রিপুরা রাজারা ছিলেন হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং তাঁরা মন্দির নির্মাণে উৎসাহী ছিলেন। ১৬ শতকে এসে, মুঘলরা ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এবং শুরু হয় মুঘল আমল। ১৭৩৩ সালে ত্রিপুরার সমতল অংশের সুবাহ বাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মুঘল আমলেই এই অঞ্চলটি কুমিল্লা নামে পরিচিতি লাভ করে।
ব্রিটিশ আমলে- ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং ১৭৯০ সালে তাঁরা কুমিল্লাকে একটি মহকুমা হিসেবে স্থাপিত করেন। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে চা বাগান স্থাপন করে চা চাষ শুরু করন এবং যা কৃষিক্ষেত্রে ব্যপক উন্নয়নে কাজ করে।
পাকিস্তান আমলে- ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর, এটি পূর্ব পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়। ১৯৫০ সালে কুমিল্লা জেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কুমিল্লা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পর, কুমিল্লা একটি উন্নত জেলায় পরিণত হয়।
** ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা নাম করণ- কুমিল্লা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতাবাদ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, ‘কুমিল্লা’ নামটি এসেছে ‘কমলাঙ্ক’ শব্দ থেকে, যার বাংলা অর্থ ‘পদ্মফুলের দীঘি’। কেউ কেউ মনে করেন, ‘কুমিল্লা’ নামটি এসেছে ‘কুমিল’ নামক একটি গ্রাম থেকে।
তবে, ত্রিপুরা রাজারা এই অঞ্চলকে ‘কুমিল্লা’ নামে অভিহিত করতেন। কুমিল্লা জেলার রয়েছে একটি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। এখানে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে শুরু করে মুঘল আমল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ, কুমিল্লা সর্বক্ষেত্রে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কুমিল্লার সেরা ও জনপ্রিয় ১০টি প্রসিদ্ধ দর্শনীয় স্থান
কুমিল্লা জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ দেশের জন্য সমৃদ্ধ শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত ঐতিহাসিক এই জেলাটি সপ্তম শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দীর বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আশ্রয়স্থল।
বহু বছর আগে এই জেলাটি সমতট জনপদের অংশ ছিল, যা কালক্রমে ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত হয়। আর কুমিল্লা নামটি এসেছে মূলত কমলাঙ্ক শব্দ থেকে, যার অর্থ পদ্মের পুকুর। কুমিল্লা বর্তমানে পর্যটন আকর্ষণগুলোর জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অনেক পরিচিত লাভ করে।
এই কুমিল্লাতেই রয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের কবরস্থান, যা কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের মাধ্যমে বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। আমরা আজকের আরটিকেলে আলোচনায় জানব, কুমিল্লার সেরা ও জনপ্রিয় ১০টি প্রসিদ্ধ দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে। চলুন তাহলে দেখি-
কুমিল্লার লালমাই পাহাড় – ইতিহাস ও কিংবদন্তি
বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার লালমাই উপজেলায় অবস্থিত লালমাই পাহাড় একটি বিচ্ছিন্ন পর্বত শ্রেণি। এটি প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে প্লাইস্টোসিন যুগে এটি গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সে হিসেব অনুযায়ী এটি বাংলাদেশের বরেন্দ্রভূমি এবং মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ের সমকালীন।
লালমাই পাহাড়ের দৈর্ঘ্য ০৮ কিলোমিটার এবং এটির সবচেয়ে চওড়া অংশটি ৪.৮ কিলোমিটার। আর এটির সর্বোচ্চ উচ্চতা ৪৬ মিটার। এই পাহাড়ের উত্তর অংশটি ময়নামতি পাহাড় এবং দক্ষিণ অংশটি লালমাই পাহাড় নামে পরিচিত।
লালমাই পাহাড়ের মাটির রঙ লাল হওযার কারণে একে লালমাই পাহাড় বলা হয়। লালমাই পাহাড় নিয়ে এক প্রচজিত গল্প আছে, রাম ও রাবণ এরমধ্যে এক যুদ্ধ সংগঠিত হয়, সে যুদ্ধে তার ছোট ভাই লক্ষণ গুরুতর আহত হন এবং বৈদ্যের নির্দেশ মতে বৈশল্যকরণী গাছের পাতার রস, তার ক্ষতস্থানে লাগানোর নির্দেশ দেয়।
সেই বৈদ্যের মতে, বৈশল্যকরণী গাছের পাতার রস লাগানোর পর লক্ষণ ভালো হয়ে যাবে। সে কারণে, হনুমান বৈশল্যকরণী গাছ আনার জন্য হিমালয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। তবে, হনুমান বৈশল্যকরণী গাছ না চিনার কারণে, তিনি গাছসহ পুরো হিমালয় পর্বতকেই তুলে নিয়ে আসে।
চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর পর্বতটা যথাস্থানে রাখার জন্য হনুমান রওয়ানা দেয়। কিন্তু, যাত্রাপথে পর্বতের একটি অংশ কুমিল্লার লমলম সাগরে পড়ে যায়। আর তখন থেকেই এস্থানের নাম লালমাই বলে পরিচিত পায়।
এছাড়াও আরো কথিত আছে যে, এক রাজার নাকি দুইটি কন্যা ছিল। তাঁর এক কন্যার নাম লালমতি এবং অপর কন্যার নাম ছিল ময়নামতি। আর তাঁদের নামানুসারে এই দুটির নামানুসারে লালমাই পাহাড় এবং ময়নামতি পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা জমিদারবাড়ি – কুমিল্লার গর্বিত ইতিহাস
কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁয়ে ডাকাতিয়া নদীরপাড়ে অবস্থিত নওয়াব ফয়জুন্নেসা জমিদারবাড়িটি। তৎকালীন সময়ে ভারতবর্ষের একমাত্র মহিলা নবাব ‘ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী’ ১৮৭১ সালে জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছোট হলেও কিন্তু, বেশ চমৎকার ও সুন্দর বাড়িটির মূল বাড়িটি দক্ষিণমুখী।
এর পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে বৈঠকখানা, পশ্চিম পাশে রয়েছে মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান এবং নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ। এটি সবুজের সান্নিধ্যে সময় কাটানোর জন্য অনেক ভালো একটা জায়গা। এখানে থাকা দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি ১৯০৩ সালে স্থাপিত, যা চক্ষু শীতল করার মতো।
ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম ও জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি বিয়ে করেন আরেক জমিদার গাজী চৌধুরীকে। কিন্তু, পরবর্তীতে সময়ে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। আর, বিবাহ বিচ্ছেদের সময় দেনমোহর হিসাবে পাওয়া এক লক্ষ এক টাকা ব্যায়ে তিনি নিজে একটি বাড়ি তৈরি করেন।
সেই সময় তিনি জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে তাঁর জমিদারি পরিচালনা করতে থাকেন। তাঁর জমিদারির বিস্তৃত ছিল প্রায় হোমনাবাদ পরগণা যা, বর্তমান সময়ের কুমিল্লা জেলার মোট ১৪টি মৌজা ছিল।
আর এই ১৪টি মৌজাতে রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি ১৪টি কাছারি ঘর নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন, একজন শিক্ষানুরাগী জমিদার, বিশেষ করে নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি লক্ষ্য করা যেত। তাঁর, জমিদারির অধিকাংশ আয়ের টাকা তিনি নারী শিক্ষার পেছনে ব্যয় করতেন।
তাঁর, সাহসী উদ্যোগ ও সাফল্যের কারণে, তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়া, তাঁকে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘নওয়াব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। যা, পুরো ভারত উপমহাঁকেশের মধ্যে তিনি একমাত্র মহিলা হিসেবে এই উপাধি পান। তাছাড়া, ছিলেন একাধারে জমিদার, সমাজকর্মী এবং লেখিকা।
ময়নামতি জাদুঘর – বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের এক অনন্য সাক্ষী
শালবন বিহারের পাশেই রয়েছে, ময়নামতি জাদুঘর। শ্রীভবদের মহাবিহার, চারপত্র মুড়া, রূপবানমুড়া, ইটাখোলা মুড়া, কোটিলা মুড়া, আনন্দ বিহার, রানীর বাংলা ও ভোজ রাজার বাড়ি খননকালে অনেক মূল্যবান পুরাসামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়।
আর এসব পুরাবস্তু সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য কুমিল্লা কোটবাড়ীর শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে ১৯৬৫ সালে শালবনকে সামনের দিকে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়। এই জাদুঘরের প্রবেশ পথের বাঁ পাশেই রয়েছে, বুদ্ধের বিশাল একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি।
এছাড়াও, রয়েছে বেলে পাথরে দন্ডায়মান বৌদ্ধের মূর্তি, যা আনুমানিক ৭ম শতকে তৈরি করা হয়। ১২থেকে ১৩ শতকের দুটো তাম্র শাসন রয়েছে। তাছাড়া, অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মূল্যবান দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘণ্টা, (জার ওজন ৩৭০ কেজি) কালো পাথরের শিবের বাহন, তালপাতার বর্মী পাণ্ডুলিপি অন্যতম।
জাদুঘরের মূলভবনে গুরুত্বপূর্ণ পুরাবস্তুগুলো প্রদর্শন করার সময় স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণে, ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ সালে এর দক্ষিণ দিকে কছুটা বর্ধিত করা হলে, এই ভবনটি ইংরেজি ‘টি’র আকার ধারণ করে। পুরো জাদুঘর ভবনে আধার রয়েছে মোট ৪২টি। যেখানে পুরাবস্তুসমূহ প্রদর্শিত হচ্ছে।
ঐতিহাসিক এই জাদুঘরে প্রবেশ পথের বামদিকে থেকে ১ নং প্রদর্শনী আধার দিয়ে প্রদর্শনী আরম্ভ করে ক্রমানুসারে চারদিক ঘুরে ঘুরে প্রবেশদ্বারের ডান দিকে ৪২ নং আধারে প্রদর্শনী শেষ হয়েছে।
প্রদর্শনী আধারগুলোতে রয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খননের উন্মোচিত স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, প্রাচীন মুদ্রা, মৃন্ময় মুদ্রক-মুদিকা, ধাতুলিপি ফলক, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, অলংকারের অংশ, পাথরের গুটিকা এবং ঘরে ব্যবহৃত মাটির হাঁড়ি-পাতিল প্রদর্শিত হচ্ছে।
এছাড়াও, এই আধারগুলোর ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে, মেঝের ওপর জাদুঘর ভবনের বিভিন্ন স্থানে কিছু পাথর এবং ব্রোঞ্জ মূর্তিও প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। আর এসকল মূর্তির কয়েকটি প্রাচীন সমতটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত।
জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য উল্লেখযোগ্য পাথর ও ব্রোঞ্জমূর্তি, বিভিন্ন ধরনের পাথরের দন্ডায়মান লোকোত্তর বুদ্ধমূর্তি, মারীছী মূর্তি, মঞ্জুরের মূর্তি, পার্বতী মূর্তি, ত্রি-বিক্রম বিষ্ণুমূর্তি, তারা মূর্তি, হরগৌরী মূর্তি, নন্দী মূর্তি, মহিষমর্দিনী মূর্তি, মনসা মূর্তি, গণেশ মূর্তি, সূর্যমূর্তি, হেরুক মূর্তি এবং ব্রোঞ্জের বজ্রসস্ত মূর্তি ইত্যাদি।
ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক – কুমিল্লার ডিজনিল্যান্ড
ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কাটি ঢাকার জেলার কাছেই কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ী এলাকায় অবস্থিত অন্যতম একটি বিনোদন কেন্দ্র। তাছাড়া, কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার সামনে এগুলেই কোটবাড়ী বনের মধ্যে আপনি দেখতে পাবেন এক নতুন সাম্রাজ্যের।
ডিজনিল্যান্ডের আদলে তৈরি হয়েছে, ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কার বিশাল ফটক। ওয়াটার পার্ক, ডাইনোসর পার্ক, ২০টির বেশি বিভিন্ন ধরনের রাইড, পিকনিক স্পটসহ ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি এমিউজমেন্ট পার্ক। যা, সবুজ প্রকৃতি ও কৃত্রিমের ছোঁয়া মিলেমিশে একাকার ।
পার্কার ভিতরে ঢুকতেই বিশাল রয়েছে, এক নাগরদোলা জার চূড়ায় বসে পুরো পার্কের দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া পার্কে রয়েছে রেল, রোলার কোস্টারসহ শিশু-কিশোরদের নানা রাইড। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও কৃত্রিম ওয়েভ পুলের দাবিদার এই পার্কটি। উচ্চ শব্দের গানে, ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ যা বোঝানো যাবে না।
বাচ্চাদের জন্য এখানে ওয়াটার পুলে রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা, যেখানে ছোট পাহাড়ের ওপর তিনটি ওয়াটার রাইড আছে, যা আপনার পছন্দ হবেই। তবে, যারা ফ্যান্টাসি/ নন্দনের ওয়াটার কিংডমে গিয়েছেন, তাদের কাছে রাইড তুলনামূলক কিছুটা কম মনে হবে।
আপনি যখন পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে যখন উপরে উঠবেন, ঠিক তখনই ডেকে উঠবে ডায়নোসর। ডায়নোসর গুলোকে সেন্সরের মাধ্যমে মুভ করার সঙ্গে সাউন্ড ইফেক্টেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ধর্মসাগর দীঘি – রাজা ধর্মপালের খনন করা কুমিল্লার প্রাণ
কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল আকারের দীঘিটি হলো ধর্মসাগর দীঘি। রাজা ধর্মপালের নামানুসারে দীঘিটির নাম করণ করা হয়েছে ধর্মসাগর দীঘি। দীঘিটি প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বছর আগে যা, ১৭৫০ অথবা ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রজাহিতৈষী রাজা ছিলেন ধর্মপাল আর তিনি ছিলেন পাল বংশের রাজা।
সেই সময় বাংলায় ছিল দুর্ভিক্ষ, সেই কারণে রাজা দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের সাহায্যের জন্য তিনি এই দীঘিটি খনন করেন। রাজার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলের মানুষের জলের কষ্ট নিবারণ করা। সাগর নাম দিয়ে বাংলাদেশে যে কয়টি দীঘি রয়েছে, ধর্মসাগর তারমধ্যে অন্যতম।
এখানে পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলো যখন তেজহীন হয়ে আসতে থাকে, সে সময় শত শত দর্শনার্থীর পদা চারনায় ধীরে ধীরে মুখরিত হতে থাকে এই ধর্মসাগর পাড়, মনেহয় যেন প্রতিদিনই বসে এখানে মিলনমেলা। ধর্মসাগরের উত্তর কোণায় রয়েছে, কুমিল্লার শিশুপার্ক।
আপনি চাইলে শিশুপার্কে বসেও সাগরের দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন, সবুজ শ্যামল ও বিশাল বড় গাছ নিয়ে এই শিশুপার্ক। এই শিশুপার্কে বসলে মন ভরে সবুজের পরশে। কারণ, দীঘির পাড়ে থাকা সবুজ বন ধর্মসাগরকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। থরে থরে সাজানো বড় বড় গাছের সারি, তার মাঝে সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চি।
শালবন বৌদ্ধবিহার – লালমাই পাহাড়ের প্রাচীন নিদর্শন
বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম শালবন বৌদ্ধবিহার। কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ীতে বার্ডের কাছে থাকা লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায়, বিহারটির অবস্থান। এটির আশপাশে একসময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে, বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার।
এটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের মতো হলেও আকারে কিছুটা ছোট। ১৮৭৫ সালের শেষের দিকে বর্তমান কোটবাড়ী অঞ্চলে একটি সড়ক তৈরির সময়, এই ইমারতটির ধ্বংসাবশেষ উন্মোচিত হয়ে। সে সময় আবিষ্কৃত এই ধ্বংসাবশেষকে একটি দুর্গ বলে অনুমান করা হয়েছিল।
ঢাকা জাদুঘরের অধ্যক্ষ নলিনী কান্ত ভট্টাশালী ১৯১৭ সালে সে এলাকায় যান এবং উক্ত এলাকায় অনুসন্ধান পরিচালনার সময় ধ্বংসাবশেষটিকে রক্ষণা- বেক্ষণ কল্পে হরিকেল দেবের তাম্রশাসনের (খ্রিস্টীয় তের শতক) দুর্গ ও বিহার পরিবেষ্টিত এই পট্টিকেরা নগর বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
যদিও, কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিকদের মত অনুযায়ী এটি ছিল, মূলত জয়কর্মান্তবসাক নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ। এই শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। আকারে চৌকো শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনি দেয়াল পিঠ করে নির্মিত।
রানী ময়নামতির প্রাসাদ – কুমিল্লার এক রহস্যময় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, জা কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলায় কুমিল্লা- সিলেট মহাসড়কের পূর্বপাশে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে সৌন্দর্যমন্ডিত রানী ময়নামতির প্রাসাদটি অবস্থিত।
দশম শতাব্দীর দিকে চন্দ্র বংশীয় রাজা মানিক চন্দ্রের স্ত্রী ময়নামতি্তে আরাম আয়েশের জন্য এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়। ধারণা করা হয়, ময়নামতি ইউনিয়নের প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটি ৮ম থেকে ১২শ শতকের এক প্রাচীন কীর্তি।
প্রায় ১০ একর জায়গা জুড়ে লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর প্রান্তে সমতল থেকে ১৫.২৪ মিটার উচ্চতায় একটি বিচ্ছিন্ন পাহাড়ের চূড়ার ওপর রানী ময়নামতির প্রাসাদের অবস্থান। স্থানীয়রা মনে করেন, এই স্থানটিতে একটি ক্রুসাকৃতির মন্দির ছিল।
পরবর্তীত সময়ে সংস্কার করে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ যুগে ক্রমান্বয়ে ছোট আকারের একটি পূর্বমুখী মন্দির বানানো হয়। যা, ১৯৮৮ সালে সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩ মিটার গভীরে প্রাপ্ত একটি সুড়ঙ্গ পথকে সামনে খননের মাধ্যমে এই প্রাসাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
এছাড়া, প্রাথমিকভাবে এখান থেকে নির্মাণ যুগের ৪টি স্থাপত্য, ৫১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫০০ ফুট আয়তনের বেষ্টনি প্রাচীর, পোড়ামাটির ফলক, মূল্যবান প্রত্নতত্ত্ববস্তু ও অলঙ্কৃত ইট আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে প্রতিবছর ৭ বৈশাখ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাসব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োাজন করা হয়।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বহনকারী কবরস্থান
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি, যার আরেক নাম কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র। স্থানীয় লোকজন মনে করেন, এটি ইংরেজদের কবরস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৩৭ সৈন্য। এর মধ্যে ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি এবং ১ জন বেসামরিক ব্যক্তি রয়েছে।
যদিও, স্থানীয়দের ভাষায় এটি ইংরেজ কবরস্থান বলা হলেও, মূলত এখানে সারিবদ্ধভাবে শায়িত রয়েছেন মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু এবং বৌদ্ধ অনেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত এবং যুদ্ধে আহত হয়ে পরে যারা মারা যাওয়া, সাধারণ সৈনিক থেকে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
কুমিল্লা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজার। এই বাজার ও ময়নামতি সাহেবের বাজারের মাঝামাঝি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বাঁয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাড়ে চার একর পাহাড়ি ভূমিজুড়ে বাংলাদেশে অবস্থিত দ্বিতীয় এ কমনওয়েলথ সমাধিক্ষেত্র।
ডাইনো পার্ক কুমিল্লা – লালমাই পাহাড়ে জীবন্ত ডাইনোসরের জগৎ
কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ী এলাকার জামমূড়ায় লালমাই পাহাড়ে প্রায় ১২ একর জায়গা নিয়ে ডাইনোসর পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। সমতল ভূমি থেকে এটি ৪৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত যা, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত, মনোমুগ্ধকর আধুনিক এই থিম পার্কে হাজার বছর আগে বিলুপ্ত ডাইনোসররা চলা-ফেরা করে।
ডাইনোসর পার্কটির নাম হলেও, এটি ডাইনো পার্ক (Dino Park) নামে অনেক পরিচিত এবং যা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। ডাইনো পার্কের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো, ডাইনো জোনে যেতে চাইলে রঙধনু সিঁড়ির ৪০ ধাপ বেয়ে টিলায় চড়তে হবে।
ডাইনোসরগুলোর মটরাইড সবসময় নড়াচড়া ও গর্জন দর্শনার্থীদের খুবই আনন্দিত করে। প্রতিটি ডাইনোসরের নিচে লিখা রয়েছে, তাদের ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য। ডাইনো জোনের পাশেই রয়েছে, একটি কৃত্রিম ঝরনা।
আনন্দ বিহার – উপমহাদেশের শেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়
কুমিল্লা জেলা সদরের কোটবাড়ী এলাকার ময়নামতিতে অবস্থিত বাংলাদেশের অতি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য আনন্দ বিহার। ময়নামতির অন্যান্য স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটিই হলো বৃহত্তম, এই মন্দিরটিই ছিল উপমহাদেশের শেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়।
নকশা করা বর্গাকৃতির বিশাল এই বিহার কাঠামোর কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্দির ও সুন্দর এক দীঘি।মন্দিরকে ঘিরে গড়েউঠা কাঠামোর প্রতিটি বাহুতে রয়েছে, সন্ন্যাসীদের কক্ষ। বিস্তৃত আঙিনার মাঝে অবস্থিত মন্দিরের উত্তর দিকের মধ্য ভাগে রয়েছে, বিহারে প্রবেশ করার একমাত্র প্রবেশদ্বার।
আর বিহার হতে উদ্ধারকৃত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে, ৬৩টি রৌপ্য মুদ্রা, তাম্রশাসন, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পোড়ামাটির ভাস্কর্য ফলক ও মৃৎপাত্র পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত ভাঁটি উল্লেখযোগ্য, যা সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীর প্রথম দিকে দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব আনন্দ বিহার নির্মাণ করেন।
ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে বাসে অথবা ট্রেনে করে কুমিল্লা যাওয়া যায়। ধাকার সায়েদাবাদ কিংবা কমলাপুর থেকে বাস যোগে কুমিল্লা যেতে খরচ পড়বে জনপ্রতি ২২০ থেকে ৩৫০ টাকা। এই যাত্রা জন্য সময় লাগে মাত্র আড়াই ঘণ্টা।এছাড়াও, চট্টগ্রামগামী প্রায় সব ট্রেনই কুমিল্লা স্টেশনে যাত্রী বিরতি দেয়। ট্রেনের ভাড়া সিটের ধরন ভেদে ভাড়া জনপ্রতি ১৭০ থেকে ৪৬৬ টাকা। আর ট্রেনের সময়সূচী জানতে ক্লিক করুন ঢাকা টু কুমিল্লা ট্রেনের সময়সূচী ও ভাড়া ২০২৫ এই লিঙ্কে।
কোথায় থাকবেন কুমিল্লা?
কুমিল্লা রয়েছে বেশ কিছু ভাল, মাঝারি এবং সাধারণ মানের আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট। যেখানে আপনি আরাম ও নিরাপদে রাত্রী জাপন করতে পারবেন। তাছড়া এ সকল আবাসিকে রাত্রী জাপন করতে খরচ হবে ৫০০ টাকা থেকে উপরে। বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কে কুমিল্লার জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য হোটেল ও রিসোর্ট ভাড়া ক্লিক করুন।
শেষকথা- কুমিল্লার জনপ্রিয় ভ্রমণ স্থান
ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান রয়েছে, তার অনেকগুলোই এক দিনে ঘুরে আসা যায়। আর এ জন্যেই একদিনের ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে ঢাকাবাসীদের কাছে কুমিল্লা অনেক জনপ্রিয়। এরপরেও যদি ভালোভাবে ঘুরে দেখার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় থাকে, তবে ঘুরে দেখা উচিত।
তাছাড়া, ঝটিকা সফরে অনেক ছোট ছোট সৌন্দর্য্যগুলো চোখ এড়িয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, অনেকের জন্য তা ক্লান্তিকরও বটে। তাই, ঢাকার নিরন্তর যান্ত্রিকতা থেকে বেরিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চাইলে কয়েকটি দিন কুমিল্লায় পরিবার নিয়ে ঘুরে আসা যেতে পারে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url