সুন্নাহ অনুযায়ী দৈনন্দিন রুটিন – সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নবীর (সা.) জীবনধারা

আরো পড়ুনঃ ইসলামে সফলতার ৫টি মূলমন্ত্র – দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হওয়ার পথ

জানুন রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী একটি পূর্ণ দিনের রুটিন – ফজরের সময় ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ইশার পর ঘুমানো পর্যন্ত। নামাজ, দোয়া, জিকির, রুজি ও পারিবারিক জীবনের সব দিক নিয়ে বিস্তারিত ইসলামিক গাইড।

সুন্নাহ অনুযায়ী একটি দিনের পূর্ণ রুটিন – ফজর থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত ইসলামী গাইড

ইসলামী জীবনব্যবস্থায় রাসূলে পাক (সা.)- এর সুন্নাহ অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য উত্তম ও ফজিলতের কাজ। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যদি, আমরা রাসূল (সা.)-এর শেখানো পন্থায় পরিচালনা করতে পারি, তবে তা কেবল দুনিয়ার সাফল্য নয়, আখিরাতেও মুক্তির মাধ্যম হবে।

আজকের এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে, কীভাবে একজন মুসলমান রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসারে একটি পূর্ণ দিন কাটাতে পারেন – সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত। চলুন তাহলে আমরা দেখি-

সকালে ঘুম থেকে ওঠা - ফজরের সময়

ঘুম থেকে ওঠার দোয়া

** আরবি আয়াত- لْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ
** বাংলা উচ্চারণ- আলহামদুলিল্লাহিল্লাযী আহইয়ানা বাদা মা আমাতানা ইলাইহিন নুশূর। 
** বাংলা অর্থ- “সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের মৃত্যুর (ঘুম) পর পুনরায় জীবিত করলেন এবং তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।”

উপরে উল্লেখিত দোয়ার মাধ্যমে দিন শুরু করাই সুন্নাহ এবং এটি জীবনের (আল্লাহর) প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম পদ্ধতি।

মিসওয়াক বা দাঁত ব্রাশ করা 

হাদিস শরীফে এসেছে-

যদি আমার উম্মতের উপর কষ্টের আশঙ্কা না থাকতো, তাহলে আমি প্রতিটি ওযুর সময় মিসওয়াক করাকে তাদের জন্য ফরজ করে দিতাম।" (সহীহ বুখারী, হাদীস- ৮৪৭)

মিসওয়াক করার উপকারিতা

  • মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।
  • দাঁতের গোড়া মজবুত করে।
  • দাঁতের ব্যথা ও ক্ষয় প্রতিরোধ করে।
  • হজমে সহায়তা করে।
  • আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম।

সুতরাং, সুন্নাহ অনুযায়ী সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজগুলোর একটি হলো মিসওয়াক করা। এটি শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ভাবেই উপকারী।

অজু করে ফজরের সালাত জামাতে আদায়

ফজরের সময় ঘুম ত্যাগ করে, জামাতের সহিত নামাজ আদায় করা রাসূল (সা.) এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাহ। কারণ, জামাতে সালাত আদায় করলে ২৭ গুণ বেশি সওয়াব রয়েছে এবং এটি একজন মু’মিনের দৃঢ় ঈমান ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক।

সকাল - সূর্য ওঠার পর

ইশরাকের নামাজ আদায়

ফজরের সালাতের পরে সূর্য ওঠার ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর দুই রাকাত ইশরাকের সালাত আদায় করা উত্তম। এটি নফল নামাজ হলেও এর ফজিলত অনেক বেশি।

হাদিস শরীফে এসেসছে- 

“যে ব্যক্তি জামাতে ফজরের সালাত আদায় করে বসে বসে আল্লাহর জিকির করে এবং সূর্য ওঠার পর দুই রাকাত নামাজ পড়ে, সে পূর্ণ হজ ও উমরার সওয়াব পায়।” (তিরমিযী)

হালাল রুজির জন্য কাজ শুরু

সকালবেলায় কাজে যাওয়াকে রাসূলে পাক (সা.) উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, “তোমাদের রিজিক সকালে ভাগ করে দেওয়া হয়।”

কারণ, চাকরি, ব্যবসা, কৃষিকাজ কিংবা যে কোনো হালাল পেশায়, নিজের নিয়োজিত হওয়া সুন্নাহভিত্তিক জীবনের একটি অংশ।

সকালের খাবার ও সুন্নাহ

পরিমিত ও হালাল নাস্তা

প্রতিদিন সকাল ৮ থেকে ৯টার মধ্যে হালাল ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা উত্তম। রাসূল (সা.) সবসময় পরিমিত আহার করতেন।

খাওয়ার সুন্নাহ

  • খাওয়ার আগে “বিসমিল্লাহ” বলা।
  • ডান হাতে খাওয়া।
  • তিনবার চিবিয়ে খাওয়া।
  • পানির সময় বসে পান করা।
  • খাওয়ার পর দোয়া- 

** আরবি দোয়া- الْـحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا وَجَعَلَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ

** বাংলা উচ্চারণ- আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আত‘আমানা ওয়াসাক্বানা ওয়া জা‘আলানা মিনাল মুসলিমীন।

** বাংলা অর্থ- “সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের খাওয়ালেন, পান করালেন এবং আমাদের মুসলমান বানালেন।”

 এই দোয়াটি খাবার শেষে শোকরিয়া প্রকাশের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) পড়তেন। এটি মুসলিম হিসেবে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি চমৎকার উপায়। (তিরমিজি, আবু দাউদ)

দিনের মাঝামাঝি সময় - দুপুর

জোহরের সালাত জামাতে আদায়

জোহরের সালাত ফরয নামাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। সময়মতো জামাতে নামাজ আদায় করা উত্তম এবং সওয়াবের কাজ। রাসূল (সা.) তা গুরুত্বসহকারে আদায় করতেন ও উৎসাহ দিতেন।

আরো পড়ুনঃ নামাজ না পড়ার পরিণতি – কোরআন ও হাদীসের আলোকে

কায়লুলাহ বা হালকা বিশ্রাম

রাসূল (সা.) দুপুরে কিছু সময় ঘুমাতেন, যাকে কায়লুলাহ বলা হয়। কারণ, এই আধা ঘন্টার ঘুম শরীর ও মস্তিষ্ককে সতেজ রাখে, ইবাদতের জন্য শক্তি জোগায় এবং যা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস হিসেবেও বিবেচিত।

হালাল রিজিকের প্রচেষ্টা

দুপুরের বিশ্রামের পর পুনরায় কাজ চালিয়ে যাওয়া ইসলামিক রুটিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি অলসতা নয়, বরং দায়িত্বশীলতা ও পরিশ্রমে মনোযোগী হওয়ার শিক্ষা, যা রাসূল (সা.) নিজে পালন করতেন ও সাহাবিদের শিখিয়েছেন।

বিকেল - আসর পর্যন্ত সময়

আসরের সালাত জামাতে আদায়

আসর নামাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। হাদীস অনুযায়ী, এই নামাজে অবহেলা করলে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই, সময়মতো ও মনোযোগ সহকারে আসর আদায় করা অত্যন্ত জরুরি।

পরিবারের খোঁজখবর

রাসূলে পাক (সা.) পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সাথে সময় কাটাতেন। এ সময় ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা ও যোগাযোগ রাখা সুনুয়াত ও পুণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়, যা মুসলিম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ইসলামি জ্ঞান অর্জন

এ সময়টাতে কুরআন তিলাওয়াত, হাদীস পাঠ বা ইসলামিক লেকচার শোনা অত্যন্ত উপকারী। এতে ইমানের শক্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর স্মরণ বেড়ে যায় এবং জীবনের নৈতিক ও আত্মিক উন্নতি ঘটে।

সন্ধ্যা - মাগরিব থেকে ইশা

মাগরিবের সালাত সময়মতো আদায়

মাগরিবের সময় খুব সংক্ষিপ্ত, তাই সময়মতো নামাজ আদায় করা খুবই জরুরি। রাসূল (সা.) কখনো মাগরিব নামাজে দেরি করতেন না এবং সর্বদা দ্রুত ও খুশিমনে আদায় করতেন।

হালকা রাতের খাবার

রাসূল (সা.) রাতে বেশি আহার করতেন না। হালকা খাবার নিয়ে পরিবারের সাথে খাওয়া সুন্নাহ এবং সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যম।

পরিবারে সময় দেওয়া

সন্ধ্যা ও রাতের প্রাথমিক সময় পরিবারের জন্য বরাদ্দ রাখা – আলাপচারিতা, ভালো উপদেশ ও ভালোবাসা ভাগাভাগি করা সুন্নাহ।

রাত - ইশা ও ঘুমানোর সময়

ইশার সালাত জামাতে আদায়

ইশা নামাজ দিনের শেষ ফরয নামাজ। রাসূল (সা.) এটি গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন এবং ঘুমানোর আগে নামাজ পড়া সুনসান ও শান্তির জন্য পরামর্শ দিতেন। এটি ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

ঘুমের আগে জিকির

  • সুবহানাল্লাহ – ৩৩ বার।
  • আলহামদুলিল্লাহ – ৩৩ বার।
  • আল্লাহু আকবার – ৩৪ বার।
এই জিকিরটি ঘুমের জন্য প্রশান্তিদায়ক ও বরকতময়।

ঘুমানোর দোয়া ও সুন্নাহ

** আরবি দোয়া- اللَّهُمَّ بِاسْمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا

** বাংলা উচ্চারণ- “আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া” ।

** বাংলা অর্থ- “হে আল্লাহ, আমি তোমার নামে (মৃত্যু বরণ করি) ঘুমাই এবং তোমার নামেই (পুনরায়) জীবিত হই”।

ঘুমানোর সময় ওজু করে ডান পাশে শোয়া – এটি রাসূল (সা.)-এর অভ্যাস ছিল।

প্রতিদিনের বিশেষ সুন্নাহসমূহ

পাঁচ ওয়াক্ত সালাত জামাতে

নামাজ জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ও মুমিনের পরিচয়। রাসূল (সা.) জীবনে কখনো নামাজ পরিত্যাগ করেননি; যত কষ্টই হোক, তিনি তা নিয়মিত আদায় করতেন।

সকাল-সন্ধ্যার মাসনুন জিকির

প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় কিছু নির্দিষ্ট দোয়া ও জিকির রয়েছে, যা পড়লে আল্লাহর রহমত ও নিরাপত্তা লাভ হয় এবং দুঃশ্চিন্তা ও অকল্যাণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

কুরআন তিলাওয়াত

প্রতিদিন অন্তত কিছু আয়াত তিলাওয়াত করা নেক আমলের অন্যতম। এটি হৃদয় শান্ত করে, সওয়াব বাড়ায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হয়।

আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও মা-বাবার হক আদায়

সুন্নাহ অনুসারে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা একটি বড় ইবাদত। এতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় এবং রিজিক ও আয়ু বৃদ্ধি পায় বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।

সালাম দেওয়া, হাসিমুখে কথা বলা

রাসূল (সা.) সবসময় সালাম দিতেন ও মুচকি হাসতেন। এসব ছোট ছোট আমলেও রয়েছে বড় সওয়াব ও জান্নাতের আশ্বাস, যা ইসলামে সৌহার্দ্য ও ভালবাসার নিদর্শন।

হাদীসের আলোকে একটি মূল্যবান কথা

“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যার সকাল-সন্ধ্যার অবস্থা এক নয়; বরং সে যেন প্রতিদিন আল্লাহর নিকট আরও কাছাকাছি পৌঁছায়।” হাদীস সূত্র- হাকিম।

শেষকথা- কোরআন-সুন্নাহ মতে চলুন, কল্যাণময় জীবন গড়ুন

সুন্নাহভিত্তিক রুটিন মানে হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণময় জীবন। এই রুটিনে রয়েছে ইবাদত, কাজ, পরিবার, বিশ্রাম ও আত্মউন্নয়ন – সব একসাথে। আসুন, আমরা আজ থেকেই অল্প অল্প করে রাসূল (সা.)-এর জীবন অনুসরণ শুরু করি, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হতে পারি।

“আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুন্নাহভিত্তিক জীবনযাপন করার তাওফিক দিন। আমিন।”

আরো পড়ুনঃ কেয়ামতের দিন মানুষের হিসাব নেওয়ার পদ্ধতি – জান্নাত ও জাহান্নামের বাস্তব চিত্র

আমাদের ব্লগে আমরা নিয়মিত কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামি বিষয়বস্তু প্রকাশ করি। নতুন নতুন দোয়া, আমল ও সুন্নাহভিত্তিক তথ্য পেতে আমাদের পেজ ফলো করুন এবং আমাদের সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url