মানুষের সৌন্দর্যের প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে, তার ত্বকের উপর। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে আমাদের ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো পিগমেন্টেশন বা ত্বকে কালো দাগ, ছোপ-ছোপ দাগ বা অসম রঙের ছাপ, যা আমাদের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়।

বিশেষ করে, এই সমস্যা মুখে হলে এটি আরো অনেক বেশি হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এই সমস্যাগুলো সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, হরমোনের পরিবর্তন, ব্রণের দাগ কিংবা বয়সজনিত কারণেও পিগমেন্টেশন দেখা দিতে পারে।
তবে, আমরা ঘরোয়া কিছু প্রাকৃতিক উপায় অবলম্বন করে, তার নিয়মিত চর্চা করলে এই সমস্যা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। আর আজকের আর্টিকেলটি আমরা সাজিয়েছি, পিগমেন্টেশন দূর করার কার্যকরী ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে তথ্য দিয়ে। চলুন আমরা দেখি
পিগমেন্টেশন কী?- What is pigmentation?
পিগমেন্টেশন বলতে আমরা বুঝি, ত্বকে অতিরিক্ত মেলানিন উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াকে। যার কারণে, ত্বকের নির্দিষ্ট কোন অংশ গাঢ় বা কালচে হয়ে যায়। এটি সাধারণত হয়ে থেকে, সূর্যের অতি রশ্মি, হরমোন পরিবর্তন, ব্রণের দাগ বা বয়সজনিত কারণে। মুখে ছোপ-ছোপ দাগ বা কালো ছাপ এটিই তার ফলাফল।
পিগমেন্টেশন কেন হয়?- Why does pigmentation occur?
পিগমেন্টেশন হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে, সাধারণত এই সমস্যা হওয়ার পেছনে প্রধানত নিম্নের কারণগুলো সবচেয়ে বেশি দায়ী। যেমন-
- ব্রণের দাগ।
- বয়সজনিত দাগ।
- অতিরিক্ত রোদে থাকা।
- হেরিড়িটারি বা বংশগত কারণে।
- ত্বকে ইনফেকশন বা চুলকানির ফলে ঘষা লাগা।
- হরমোনের পরিবর্তন, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় বা পিরিয়ডের কারণে।
পিগমেন্টেশন কি পুরোপুরিভাবে দূর করা সম্ভব?- Is it possible to completely remove pigmentation?
পিগমেন্টেশন যদিও, পুরোপুরিভাবে দূর করা সম্ভব নয়। তবে, তা অনেকটাই হালকা করার মাধ্যমে ত্বককে স্বাভাবিক ও উজ্জ্বল করে তোলা সম্ভব হয়। এরজন্য নিয়মিতভাবে ত্বকের ঘরোয়া যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভাস ও কিছু কার্যকরী হোম রেমেডি দারুণভাবে কাজ করে।
পিগমেন্টেশন দূর করার কার্যকরী ঘরোয়া উপায়?- Effective home remedies to remove pigmentation?

পিগমেন্টেশন দূর করার কার্যকরী উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে, লেবু, মধু, আলু, অ্যালোভেরা, টমেটো, শসা, হলুদ ও মুলতানী মাটি ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক উপাদান, যা নিয়মিত ব্যবহার করতে হয়, সঙ্গে সানস্ক্রিন ব্যবহার অপরিহার্য।
তাছাড়াও, এই সকল উপাদানগুলোর সঙ্গে আরো অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে ফেসপ্যাক বানিয়ে ব্যবহার করলে, ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। নিচে পিগমেন্টেশন দূর করার জন্য ১০টি কার্যকরী ঘরোয়া ফেসপ্যাক সম্পর্কে দেখুন-
লেবুর রস ও মধুর ফেসপ্যাক- Lemon juice and honey face pack
লেবুতে যে প্রাকৃতিক ব্লিচিং উপাদান পাওয়া যায়, তা ত্বকের কালো দাগ হালকা করতে খুবই কার্যকরী। অপরদিকে মধু ত্বককে সাহায্য করে, আর্দ্র, কোমল-মসৃণ ও নরম রাখতে। এটি নিয়মিতভাবে ব্যবহারে পিগমেন্টেশন কমে। নিম্নে এই দুটি উপাদানে প্যাক তৈরি ও ব্যবহার সম্পর্কে দেখুন-
১ টেবিল চামচ করে লেবুর রস এবং মধু একসঙ্গে মিশিয়ে একটি প্যাক বা পেস্ট তৈরি করুন। এবার প্যাকটি মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিটের মত অপেক্ষা করুন এবং হালকা গরমপানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। তবে, সংবেদনশীল ত্বকে লেবুর রস সরাসরি ব্যবহার না করাই ভালো। তাই আগে প্যাচ টেস্ট করে নিন।
শসা ও গোলাপজলের ঠান্ডা প্যাক- Cucumber and rose water cold pack
শসায় পাওয়া যায় প্রচুর পানি, যা ত্বকের অতিরিক্ত গরমভাবসহ লালচে ভাব দূর করতে সাহায্য করে। আর গোলাপজল ত্বককে ঠান্ডা করতে সহায়তা করে। ফলে উপাদান দুটি ব্যবহারে ত্বক টোন করে এবং ছোপ-ছোপ দাগ হালকা করে। নিচে শসা ও গোলাপজলের ঠান্ডা প্যাক তৈরি ও ব্যবহার সম্পর্কে দেখুন-
শসা ব্লেন্ড করে এর রস ২ টেবিল চামচ এবং গোলাপজলের পানি ১ টেবিল চামচ এক সঙ্গে মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন এবং তুলা বা কটনের সাহায্যে ত্বকে লাগিয়ে ২০ মিনিটের মত রেখে, স্বাভাবিক পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই মিশ্রণটি নিয়মিত ব্যবহার করলে, কালো দাগ হালকা হয় এবং ত্বকে ঠান্ডা ভাব আসে।
টমেটো ও বেসনের মিশ্রণ- Tomato and gram flour mixture
টমেটোতে পাওয়া যায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান, যা ত্বকের দাগ ও কালচে ভাব কমাতে সাহায্য করে। আর বেসন ত্বকের মরা কোষকে দূর করে এবং ত্বককে পরিষ্কার, উজ্জ্বল ও মসৃণ রাখতে সাহায্য করে।নিম্নে এই দুটি উপাদানে প্যাক তৈরি ও ব্যবহার সম্পর্কে দেখুন-
১ টেবিল চামচ করে টমেটর রস ও বেসনের সঙ্গে ২ ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে একটি ্পেক তৈরী করুন এবং এটি আপনার মুখে লাগিয়ে ১৫/২০ মিনিট অপেক্ষা করে, পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
আলুর রস – প্রাকৃতিক ব্লিচ- Potato juice – natural bleach
আলুর রসে পাওয়া যায় ক্যাটেকলেস নামক একটি বিশেষ এনজাইম, যা ত্বকের মেলানিন উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ত্বকের বিভিন্ন দাগ ও পিগমেন্টেশন হালকা করতে সাহায্য করার সাথে সাথে, ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতাকে ফিরিয়ে আনে।
প্রথমে একটি মাঝারি সাইজের আলুকে ব্লেন্ড করে রস বের করুন এবং কটন বা তুলার সাহায্যে মুখে লাগিয়ে অপেক্ষা করুন। হালকা শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই উপাদানটি দিনে ২ বার ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
হলুদ ও মধুর ফেসপ্যাক- Turmeric and honey face pack
হলুদে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা আমাদের ত্বকের প্রদাহ কমায় এবং জীবাণুকে দূর করে। তাছাড়া, এটি দাগ হালকা করে এবং ত্বকে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা ও স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনে। নিম্নে হলুদ ও মধুর ফেসপ্যাক তৈরি ও ব্যবহার দেখুন-
প্রথমে ১ চিমটি কাচা হলুদের গুড়ো নিন এবং এর সঙ্গে ১ টেবিল চামচ টক দই বা মধু ভালোভাবে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখে লাগিয়ে, ১৫ মিনিটের মত রাখার পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটি নিয়মিত ব্যবহার করলে ত্বকের পিগমেন্টেশন অনেক কমে।
অ্যালোভেরা জেলের ম্যাজিক- The magic of aloe vera gel
ত্বকের জন্য অ্যালোভেরা একটি প্রাকৃতিক উপাদান, যা বিভিন্ন দাগ হালকা করতে বিশেষভাবে কার্যকর। তাছাড়া, এটি ত্বকের কোষ মেরামত করে, আর্দ্রতাকে ধরে রাখে এবং ত্বককে মসৃণ ও কোমল করে তোলে। এটি নিয়মিত ব্যবহারে ত্বকের পিগমেন্টেশন visibly কমে। নিম্নে অ্যালোভেরা ফেসপ্যাক তৈরি ও ব্যবহার দেখুন-
প্রথমে ফ্রেশ অ্যালোভেরা পাতা নিন এবং পাতা থেকে জেল বের করুন। এই জেলটি রাতে ঘুমানোর আগে মুখে লাগিয়ে রাখুন এবং সকালে হালকা ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। প্রাক্রিতিক এই উপাদানটি নিয়মিত ব্যবহারে পিগমেন্টেশন ধীরে ধীরে হালকা হয়।
তুলসী পাতা ও মুলতানী মাটির প্যাক- Tulsi leaves and multani mitti pack
তুলসী পাতায় যে প্রাকৃতিক উপাদান পাওয়া যায়, তা ত্বকের জীবাণু ও ব্রণ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে দূর করতে সাহায্য করে। অপরদিকে মুলতানী মাটি ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করার পাশাপাশি রোমছিদ্র পরিষ্কার করে। ফলে ত্বক হয়ে উঠে উজ্জ্বল ও দাগমুক্ত। নিম্নে এই তৈরি ও ব্যবহার দেখুন-
প্রথমে ৪/৫টি তাজা তুলসি পাতা ধুয়ে বেটে নিন, এর সঙ্গে ১ টেবিল চামচ মুলতানি মাটি ও পরিমাণ মতো গোলাপজল মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরি করুন। এবার আপনার তৈরী প্যাক মুখে লাগিয়ে শুকানোর জন্য অপেক্ষা করুন, শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। এই উপাদানটি সপ্তাহে ২ বার ব্যবহার করা যায়।
রোদ থেকে বাঁচুন – সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন- Avoid the sun – use sunscreen
ঘরোয়া প্যাক যতই ব্যবহার করুন না কেন, রোদ থেকে না বাঁচতে পারলে পিগমেন্টেশন পুনরায় ফিরে আসবে। তাই, প্রতিদিন ঘরের বাইরে যাওয়ার আগে আমাদের অবশ্যই SPF ৩০ বা তার বেশি সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
ভেতর থেকে যত্ন – খাবারে সচেতনতা- Care from within – Food awareness
ত্বকের দাগ ও পিগমেন্টেশন কেবলমাত্রা বাইরের যত্নেই দূর করা সম্ভব না। তাই, ভেতর থেকে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই অপরিহার্য। যেসকল খাবার পিগমেন্টেশন কমায়, তা নিম্নে দেখুন-
- দুধ, ডিম, বাদাম
- প্রচুর পানি পান করুন।
- মৌসুমিসহ সবুজ শাক-সবজি।
- ভিটামিন C সমৃদ্ধ ফল যেমন, কমলা, লেবু, আমলকি।
- অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট জাতীয় বিভিন্ন খাবার যেমন ব্লুবেরি, গ্রিন টি।
ঘুম ও স্ট্রেসকে কমান- Reduce sleep and stress
আমাদের অপর্যাপ্ত ঘুমের পাশাপাশি অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা পিগমেন্টেশনের অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। তাই, প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম নিশ্চিত করা, নিয়মিত মেডিটেশন করা এবং স্ট্রেস কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এতে ত্বক হবে উজ্জ্বল ও দাগমুক্ত থাকবে।
ত্বকের কালো দাগ দূর করা ঘরোয়া উপায়- শেষকথাঃ Home remedies to remove dark spots on the skin - Final Thoughts
পিগমেন্টেশন যদিও ত্বকের সৌন্দর্য নষ্ট করে, তবুও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। নিয়ম করে ঘরোয়া হ্যাক ও কিছু ভালো অভ্যাস মেনে চললেই মুখের ছোপ-ছোপ দাগ অনেকটাই হালকা করা সম্ভব। তবে, যাদের সমস্যা অনেক বেশি বা দীর্ঘদিনের, তাদের ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।
তাছাড়া, আমাদেরকে একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে যে, ঘরোয়া উপায়গুলোতে ফল পাওয়ার জন্য কিছুটা সময় লাহতে পারে। তাই, আমারা যদি ধৈর্য ধরে নিয়মিত চর্চ করি, তাহলে আমরা ফিরে পাবো, দাগমুক্ত, কোমল- হাস্যজ্জ্বল ও মসৃণ ত্বক।
আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিত এবং পারিবারের সঙ্গে শেয়ার করবেন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আরটিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url