মেয়েদের মাসিকের সমস্যা কি- কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের ঘরোয়া উপায়

আরো পড়ুনঃ ব্রেইন ক্যানসার- কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়

মাসিক বা ঋতুস্রাব (Menstruarion) হলো মেয়েদের জীবনের অন্যতম একটি স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক প্রক্রিয়া, যা তাদের গর্ভধারণের প্রস্তুতির বিশেষ অংশ হিসাবে প্রতি মাসে ঘটে থাকে।

সাধারণত মেয়েদের বয়স ১১ থেকে ১৫ বছর হলে মাসিক শুরু হয় এবং মেনোপজ বা রজোনিবৃত্তি (যা ৪৫ থেকে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত) পর্যন্ত চলমান থাকে। তবে, অনেক মেয়েদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে মাসিক চক্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে।

আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, মেয়েদের মাসিকের সমস্যা কী, এই সমস্যা হওয়ার সম্ভাব্য কারণ, এর লক্ষণ কিভাবে বুঝা যায় এবং ঘরোয়াভাবে এর কিছু প্রতিকার সম্পর্কে, যাতে মাসিকের সমস্যা থেকে উপশম পাওয়া যায়। চলুন তাহলে আমরা দেখি- 

মেয়েদের মাসিকের সমস্যা কি?- What are the menstrual problems of girls?

মাসিকের সমস্যা বলতে সাধারনভাবে বলা যায়, মেয়েদের মাসিক চক্রে যে কোন ধরণের অনিয়ম বা অস্বাভাবিকতা। এর মধ্যে নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার নাম বা ধরণ দেখুন-

  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Excessive bleeding)
  • তীব্র কোমর বা পেট ব্যথা (Severe back or stomach pain)
  • সময়মতো মাসিক না হওয়া (Not menstruating on time)
  • মাসিক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া (Complete cessation of menstruation)
  • খুব অল্পসময় বা দীর্ঘ সময় রক্তপাত (Bleeding for a very short or long time)
  • মানসিক অস্থিরতা, মুড সুইং বা বিষণ্নতা (Mental instability, mood swings or depression)

মাসিকের সমস্যা হওয়ার কারণ কি?- What causes menstrual problems?

মাসিকের সমস্যা সাধারণত মেয়েদের হরমোনসহ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। নিম্নে মেয়েদের মাসিকের সমস্যা হওয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-

** ভারসাম্যহীন হরমোন- যদি কারো ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের স্বাভাবিক পরিবর্তনের ব্যাঘাত ঘটে, সেক্ষেত্রে মাসিক চক্রে প্রভাব ফেলতে পারে। হরমোনের এই ভারসাম্যহীনতা মাসিক অনিয়মের অন্যতম প্রধান কারণ।

** পলিসিস্টিক ওভার সিন্ড্রোম- হরমোনজনিত এই সমস্যাটি একটি জটিল রোগ, যার ফলে ডিম্বাশয়ে অনেক ছোট সিস্ট তৈরি হয়। এতে অনিয়মিত মাসিক, ওজন বৃদ্ধি, ব্রণ, অধিক লোম গজানো ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের উপসর্গ দেখা দেয়।

** অতিরিক্র দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ- যদি কারো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ থাকে, তবে এটি হাইপোথ্যালামেসে প্রভাব ফেলে, যা হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে নিয়মিত মাসিক চক্রে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

** ওজনের তারতম্যতা- যদি কোন মেয়েদের ওজন অত্যাধিক বেশি বা অত্যান্ত কম হয়, সেক্ষেত্রে শরীরের হরমোনের ভারসাম্যকে নস্ট করে দেয় এবং নিয়মিত মাসিক চক্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।

** অলস জীবনধারা বা অতিরিক্ত শরীরচর্চা- যদি কোন নারী খুব অল্প শারীরিক কার্যকলাপ বা অত্যাধিক শরীরচর্চা করেন, তবে এই দূটি হরমোনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

** গর্ভনিরোধক বা অন্যান্য ওষুধের সেবন- গর্ভনিরোধক ওষুধ, মানসিক রোগের ওষুধ, স্টেরয়েড বা কেমোথেরাপির মতো ওষুধ সেবনে নিয়মিত মাসিক চক্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে।

** থাইরয়েড সমস্যা- থাইরয়েড গ্রন্থি যদি কোন নারীর কম বা বেশি উৎপাদন করে, সেক্ষেত্রে সেটি মাসিকের অনিয়মের অন্যতম কারণ হতে পারে।

মাসিকের সমস্যার লখণ কি?- What are the signs of menstrual problems?

মেয়েদের মাসিকের সমস্যা হলে, তা কয়াকটি লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে পারা যায়। এই মধ্যে সাধারণত নিম্নের সমস্যাগুল দেখা দিলে বুঝতে হবে যে, মাসিকের সমস্যা হয়েছে। যেমন- 

  • মাথা ঘোরা, দুর্বলতা বা ক্লান্তি।
  • অনেক কম বা অতিরিক্ত রক্তপাত।
  • সময়ের আগে বা পরে মাসিক হওয়া।
  • মাসিক চলাকালে তীব্র পেট ও কোমর ব্যথা।
  • বয়সের আগেই মাসিক একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • অতিরিক্ত ব্রণ হওয়া ও লোম গজানো বা চুল পড়ে যাওয়া।

মাসিকের সমস্যা সমাধানের ঘরোয়া উপায়- Home remedies for menstrual problems

মাসিকের সমস্যা যদিও হরমোন জনিত কারণে বেশিরভাগ সময় হয়ে থাকে। তবে, আমাদের হাতের কাছে এমন গাছে রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে খুব সহজে এই সমস্যা থেকে কার্যকরী সমাধান পাওয়া সম্ভব। নিম্নে মাসিকের সমধানের গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া এবং প্রাকৃতিক উপায় আলোচনা করা হলো-

তুলসী পাতা- Basil leaves

তুলসী পাতা হরমোনের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়। এটি প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধ খমতা বাড়ায় এবং দূর করে দেহের বিষাক্ত উপাদান। তুলসী পাতা প্রতিদিন সকালে খালি পেটে কাচা পাতা চিবিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, এটি নিয়মিত খাওয়া স্বাস্থ্যকর অভ্যাস।

আরো পড়ুনঃ বান্ধ্যত্ব রোগ কি? কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা

আদা চা- ginger tea

আদা চা বেশ পরিচিত তার অ্যান্টি ইনফ্লামেটরী গুণের জন্য, যা পেটের ব্যথা কমানোর পাশাপাশি মাসিক চক্রকে নিয়মিত রাখতে সাহায্য করে। হাফ চা চামচ থেতানো আদা এক কাপ পানিতে সেদ্ধ করে দিনে ১/২ বার পান করেলে, অনেক উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, এটি নিয়মিত পান করা স্বাস্থ্যকর অভ্যাস।

চিয়া বীজ ও ফ্ল্যাক্সসিড বা তিসি বীজ- Chia seeds and flaxseeds

চিয়া বীজ ও ফ্ল্যাক্সসিড বা তিসি বীজে পাওয়া যায় প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও লিগনানস, যা হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বক ও হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারি। প্রতিদিন ১ চা চামচ চিয়া বা ফ্লাক্সসিডের গুডো করে, স্মুদি, দুধ বা পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিয়মিত খাওয়া যায়।

দারচিনি- cinnamon

রক্ত সঞ্চালনকে বাড়াতে সাহায্য করে দারচিনি এবং শরীরের নানান ধরণের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। প্রাকৃতিকভাবে প্রদাহ নাশক এই উপাদানটি। দারচিনির গুড়ো এক চিমটি করে গরম পানিতে মিশিয়ে দিনে ১/২ বার নিয়মিত পান করলে উপকার পাওয়া যায়।

পুদিনা পাতা- mint leaves

শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে পুদিনা পাতা এবং মাসিকের সময় যে ব্যথা এবং অস্বস্তি হয় তা কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ১ বার করে পুদিনা পাতার পান করুন কিংবা বেটে এর রস পান করতে পারেন। তাছাড়া, পুদিনা পাতা হজমেও সাহায্য করে এবং নিয়মিত সেবন করলে উপকার মেলবে।

হলুদ ও দুধ- Turmeric and milk

হলুদে পাওয়া যায় অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরী গুন, যা ব্যথা এবং মাসিক চলাকালীন সময়ে অস্বস্তি কামাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস গরম দুধের সঙ্গে হাফ চা চামচ হলুদ মিশিয়ে পান করলে অনেক আরাম পাওয়া যায়। তাছাড়া, এটি নিয়মিত পান করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ খমাতা বৃদ্ধি পায়।

মেথি বীজ- Fenugreek seeds

হরমোনের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে মেথি বীজ এবং মাসিকজনিত ব্যথা উপশমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১ চা চামচ মেথি বীজ পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রেখে, সেই পানি সকালে খালি পেটে পান করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, মেথিতে যে প্রাকৃতিক উপাদান পাওয়া যায়, তা শরীরকে ভিতর থেকে শক্তি জোগাতে সাহায্য করে।

পর্যাপ্ত পানি পান ও বিশ্রাম- Drink enough water and rest.

হরমোনের ভারসাম্য ঠিক রাখে পর্যাপ্ত পানি পান ও বিশ্রাম এবং দেহের স্বাভাবিক পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পানি যেমন শরীরকে দেয় ডিটক্সিফাই করে, তেমনি ঘুম এনে দেয় মানসিক প্রশান্তি। তাই, প্রতিদিন কমপক্ষে ৭/৮ ঘন্টা ঘুমানো এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করে সুস্থ থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়াও-

  • ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন।
  • সুসম খাদ্য গ্রহন করুন।
  • প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করুন।
  • অ্যালকোহল ও ধুমপানকে না বলুন।
  • তেল ও মশলাযুক্ত খাবারকে এড়িয়ে চলুন।
  • মাসিক যদি দীর্ঘদিন অনিয়মিত হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

মাসিকের সমস্যায় কখন ডাক্তারে কাছে যাবেন- When to see a doctor for menstrual problems

যদিও মাসিকে সমস্যা ঘরোয়া উপায়ে, প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে অনেক কার্যকরী উপকার পাওয়া যায়। তবে, যদি নিম্নের সমস্যাগুল দেখা দেয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করা জরুরি। যেমন-

  • গর্ভধারণে সমস্যা হলে।
  • একাবারে মাসিক বন্ধ হয় গেলে।
  • অসহ্য ব্যথা বা অতিরিক্ত দুর্বলতা হলে। 
  • ১৫ বছর বয়স পেরিয়ে গেলেও মাসিক না এলে।
  • মাত্রাতিরিক্ত রক্তপাত হলে (প্রতি ঘণ্টায় প্যাড পরিবর্তন করতে হলে)

মাসিকের সমস্যার ঘরোয়া উপায়- শেষকথা: Home remedies for menstrual problems - final words

মাসিকের সমস্যাকে অনেক নারীরা সাধারণ সমস্যা মনে করেন। তবে, এটিকে স্বাভাবিক বলে উপেক্ষা করা উচিত নয়। এই জন্য সময়মত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, ঘরোয়া প্রতিকার এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহন করলে, মাসিকের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। শরীরের যত্নের পাশাপাশি মনের যত্ন নেওয়া মানে মাসিক চক্র ঠিক থাকা।

আরো পড়ুনঃ হরমোন মানুষের দেহের গোপন নিয়ন্ত্রক- হরমোন কী?

আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিতদের সঙ্গে শেয়ার করুন, তারাও যেন উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url