বজ্রপাত কেন হয়?- কীভাবে বাঁচবেন?- তালগাছ কিভাবে বজ্রপাত প্রতিরোধ করে?

আরো পড়ুনঃ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নওগাঁর মাটির প্রাসাদ

বাংলাদেশের অবস্থান জলবায়ু ও ভৌগোলিক দিক থেকে বজ্রপাতের ঝুকি বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর গ্রীস্ম ও বর্ষাকালে বজ্রপাতের কারণে প্রচুর প্রাণহানির ঘটতেছে।

যদিও, এটি আমাদের জন্য অনেক দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ বজ্রপাত সম্পর্কে অসেচতন বা সচেতন নয়। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য যেমন প্রয়োজন, আধুনিক সতর্কতা বার্তা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তেমনিভাবে আমাদের প্রয়োজন প্রাকৃতিক সহায়তাকে কাজে লাগানো।

আর তালগাছ হলো সেই অন্যতম এক প্রাকৃতিক সুরক্ষাবলয়, যা বজ্রপাত প্রতিরোধে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা আজকে আপদের সঙ্গে শেয়ার করবো, বজ্রপাত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য। যা, আমাদের চলার পথে অনেক অবদান রাখবে। তাহলে চলুন আমরা দেখি- 

বজ্রপাত কি?- কেন হয় বজ্রপাত?- 

বজ্রপাত হলো প্রাকৃতিক একটি বৈদ্যুতিক নির্গমন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সাধারণত ঘটে থাকে আকাশে মেঘের মধ্যে বা মেঘ থেকে মাটিতে বিশাল পরিমাণ বৈদ্যুতিক চার্জ সঞ্চালিত হয়ে থাকে। বজ্রপাত বেশিরভাগ সময় বজ্রগর্ভ মেঘ (ইংরেজিতে বলে Cumulonimbus cloud) এর মাধ্যমে হয়ে থাকে।

এইসকল মেঘগুলোর ভেতরে থাকা বরফ কণা, জলকণা এবং গ্যাসের অণুকণাগুলোর সংঘর্ষের কারণে উৎপন্ন হয়ে থাকে। আর যে সময় চার্জের যখন তারতম্য বেশি পরিমাণে হয়ে যায়, তখন সেটি বজ্রপাত এর মাধ্যমে নির্গত হয়। পাশাপাশি বিকট শব্দ ও উজ্জল আলো উৎপন্ন হয়, যাকে আমরা "বজ্রপাত" ও "বিদ্যুৎ চমক" বা "বাস পড়া" হিসাবে জানি।

বজ্রপাতের ভয়াবহ দিক এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব

বজ্রপাত অনেক ভয়াবহ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রভাবের কারণে প্রতিবছর অনেক প্রাণহানি ঘটে। নিম্নে এই বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো- 

বজ্রপাতের কারণে প্রাণহানি

বজ্রপাতের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে ২০০ থেকে ৩৫০ জন মানুষ মারা যায়। বিশেষ করে এটি ঘটে থাকে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত, যা বাংলাদেশে বজ্রপাতের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সময়।

বজ্রপাতে যারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ

  • পথচারী ও শিক্ষার্থী।
  • কৃষক, যারা মাঠে কাজ করেন।
  • জেলে ও নদী এলাকায় কাজ করা লোকজন।
  • শিশু- কিশোর, যারা খেলার জন্য খোলা জায়গায় থাকে।

বজ্রপাতে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি

বজ্রপাত যে কেবলমাত্র মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে খ্যন্ত হয়, তা কিন্তু নয়, বরং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে বসতবাড়ি এবং গবাদি পশুর অনেক ক্ষতি সাধনও করে থাকে।

বজ্রপাতের লক্ষণ এবং পূর্বাভাস কি কি?

বজ্রপাত ঘটার আগে সাধারণত কয়েকটি লক্ষণ বা পূর্বাভাস দেখতে পাওয়া যায়। যেমন-

  • পাখি বা অন্য প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণ।
  • আকাশ অনেক ঘন কালো হয়ে যাওয়া।
  • বাতাস গরম ভাব এবং আর্দ্রতা বেশি।
  • হঠাত করে বাতাস স্থির হয়ে যাওয়া।
  • গর্জন ও বিদ্যুতিক ঝলকানি।

এছাড়াও, বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রপাতের সতর্কতা বা Nowcast বার্তা তাদের নির্দিষ্ট অ্যাপে পাওয়া যায়। যেমন-

  • "বজ্রপাতের সম্ভাবনা আছে"।
  • "বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে"।
  • "ঘন কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে"।

বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায়- বজ্রপাতের সচেতনতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা

** যানবাহনে অবস্থান- গাড়ি, বাস বা ট্রাক ইত্যাদি ধাতব গঠনযুক্ত যানবাহন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ আশ্রয়।

** প্লাস্টিক জুতা বা রাবারের তলা বিশিষ্ট জুতা ব্যবহার- এই সকল জুতা আপনাকে বজ্রবিদ্যুৎ থেকে অনেটা সুরক্ষা দিতে পারে।

** বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বন্ধ রাখুন- বজ্রপাত সলাকালীন সময়ে কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইলের চারজার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।

** খোলা স্থান থেকে সরে থাকা- বজ্রপাত চলাকালীন সময়ে মাঠ, ধানক্ষেত, জলাশয়ের কাছে থাকা যাবে না। এই সময় পাকা কোন ঘরের ভিতর আশ্রয় নেওয়া।

** তালগাছ বা উচু কোন খুটির নিচে না দাঁড়ানো- মোবাইলের টাওয়ার, বিদ্যুতিক খুটি বা তালগাছকে বজ্রপাত আকর্ষণ করে। তাই, এ গুলোর নিচে আশ্রয় নেওয়া অনেক বিপজ্জনক।

আরো পড়ুনঃ নওগাঁ জেলার প্রাচীন ইতিহাস- নওগাঁ জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত হয়েছে?

** দুই কানে আঙ্গুল দিয়ে বসে পড়ুন (Squat Position)- খোলা জায়গায় হঠাত বজ্রপাত শুরু হলে  মাটিতে বসে পড়ুন, মাথা নিচু করুন, কানে আঙ্গুল দিন, কিন্তু মাটিতে হাত স্পর্শ করবেন না।

বজ্রপাতের সময় স্কুল, কৃষি মাঠ ও জনবসতিতে করণীয়

  • মাঠে কৃষিকাজ করার সময়, আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো করে যানা।
  • সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বজ্রপাত সম্পর্কে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা।
  • প্রতিটি বিদ্যালয়ে সাইরেন ব্যবস্থা বা সতর্ক ঘন্টা ব্যবস্থা চালু।
  • বজ্রপাত বিরোধী যন্ত্র (Lightning Arrestor) ব্যবস্থা স্থাপন।
  • তাল গাছসহ বজ্রনিরোধক গাছ বা বৃক্ষ রোপন করা।

বজ্রপাত প্রতিরোধে তাল গাছের ভূমিকা 

বাংলাদেশে এই কথা প্রচলিত রয়েছে যে, "তাল গাছ বজ্রপাত প্রতিরোধক"। এই কথাকে কোনভাবেই ছোট করে দেখা যাবেনা। কারণ, এ কথার পিছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। আর তাল গাছের যে সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, বজ্রপাত প্রতিরোধের তা নিম্নে আলোচনা করা হলো-

** গবেষণালব্ধ তথ্য- আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে যে, বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় যদি, তাল গাছের উপস্থিতি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ কমে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ।

** ভেজা কাঠ ও তরল পদার্থের উপস্থিতি- তাল গাছের ভেতরে রয়েছে প্রাকৃতিক আর্দ্রতা এবং তরল উপাদান, যা বজ্রবিদ্যুত মাটির দিকে সরিয়ে দেয়, ফলে এর আশে পাশে থাকা মানুষ ও বস্তু থাকে নিরাপদ।

** নিরাপদ দূরত্ব সৃষ্টি- খোলা মাঠ বা উম্মুক্ত স্থানে তাল গাছ থাকলে, মানুষ তার কাছা কাছি না থেকে নিরাপদে থাকতে শিখে, যা পরোক্ষভাবে সুরক্ষা দেয়।

** উচ্চতা ও কাঠামো- তাল গাছ যেহেতু অনেক উচু হয় এবং খাড়া হয়ে থাকে, যা বজ্রবিদ্যুতকে খুব সহজে আকর্ষণ করে ও ভূমিতে সঞ্চালিত করে।

** সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ- গত ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসাবে ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে নিম্নের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন- 

  • তাল গাছসহ বজ্রপাত প্রতিরোধক গাছ রোপন প্রকল্প গ্রহন।
  • বিভিন্ন পর্যায়ে বজ্রপাত বিষয়ক প্রশিক্ষণ চালু করা।
  • ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় Lightning Arrestor স্থাপন করা।
  • সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে প্রচার করা।
বেসরকারি সংস্থা বা এনজিওরা তাল গাছ রোপন কর্মসূচী, প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে কাজ করছে। যাতে-
  • ভবিষযাতে মানুষকে বজ্রপাত থেকে বাঁচানো যায়।
  • তাল গাছ রোপনে সচেতনতা অনেক জরুরি।
  • তাল গাছে গরমে ফল ও ছায়া প্রদান করে।
  • তালগাছ পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখে।
  • বিভিন্ন পাখির আবাস স্থান তাল গাছ।

কোথায় পাওয়া যাবে তাল গাছের চারা?

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের ন্যায়, নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলায় বিশাল বড় তাল গাছের চারার নার্সারি রয়েছে। সেখানে প্রতিটি তাল গাছের চারা খুব মূল্যে পাওয়া যায়। যেখানে প্রতিটি তাল গাছের মূল্য মত্র ৫০ টাকা। তাছড়া, একসঙ্গে ৫০০ টি চারা কিনলে, দেশের যে কোন স্থানে বিনা খরচে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। নিচে নার্সারি ঠিকানা দেখুন
  • মন্ডল নার্সারি
  • প্রোপাইটার মোঃ বেলাল উদ্দীন মন্ডল
  • বেলীর মোড
  • নিয়ামতপুর নওগাঁ।
  • মোবাইল নম্বর- ০১৭১৮১৫৯৯২৮।

কিভাবে তাল গাছ লাগানো লাগবে?

  • খোলা জায়গায়, মাঠ, বিদ্যালয় চত্বর, জলাশয় ও নদীর ধারে লাগানো উপযুক্ত।
  • বর্ষার আগে বা পরবর্তী মৌসুমে লাগালে তাল গাছ ভালোভাবে বাচে।
  • গাছের সুরক্ষার জন্য তাল গাছের চারদিকে বেড়া দেওয়া ভালো।

 বজ্রপাতের কারণ, লক্ষণ ও নিরাপত্তা- শেষকথা

বজ্রপাত যদিও একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তবে সচেতনতা ও প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এই ক্ষেত্রে তাল গাছ সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

যা যুগ যুগ ধরে বজ্রপাত থেকে মানুষকে অনেক রক্ষা করে আসছে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে তাল গাছ রোপণ করি, বজ্রপাতের বিপদ সম্পর্কে সচেতন হই এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

আরো পড়ুনঃ জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে চেক করার নিয়ম 2023

আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি আপনার পরিচিতিদের সঙ্গে শেয়ার করুন, যাতে তারাও উপকৃত হন। আরো নতুন নতুন তথ্য যানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url